সেই দিন অফিসে যাওয়ার কথা ছিল সকাল ৮টায়। কিন্তু স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে অফিসে দায়িত্ব পালনের সময় পরিবর্তন করে নিয়েছিলেন সন্ধ্যা ৭টায়। অফিস যাওয়ার আগে বাইরের পরিস্থিতি দেখতে ও স্ত্রীর ওষুধ কিনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। তাঁর নাম ইমরান খলিফা (৩৩)। তিনি গুলশান-২-এর চারুলতা নামের একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া ইউনিয়নের কালনা গ্রামে।
শুক্রবার সকালে ইমরান খলিফার বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় নিহত ইমরানের বাবা নজরুল ইসলাম (৬৮) ও মা সেলিনা আক্তার (৫০)। স্বজনদের আহাজারিতে বাড়ির পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।
ইমরানের স্ত্রী শান্তা ((২২) বলেন, ‘ঘটনার দিন শুক্রবার (১৯ জুলাই) ইমরানের অফিসে ডিউটি ছিল সকাল ৮টায়; কিন্তু আমি অসুস্থ হওয়ার কারণে আগের দিন রাতে অফিসের বড় স্যাররে ফোন দিয়ে সময় পরিবর্তন করে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ডিউটি করার অনুমতি নেয়। শুক্রবার দুপুরে অফিস থেকে একজন (স্যারে) ফোন দিয়ে ইমরানকে বলেন, “যদি পরিস্থিতি ভালো থাকে, তাহলে অফিসে এসো, আর যদি পরিস্থিতি খারাপ থাকে, তাহলে অফিসে আসার দরকার নাই।” বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ইমরান অফিসে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাতের খাবার প্রস্তুত করতে বলে ঘরের বাইরের পরিস্থিতি দেখতে ও আমার জন্য ওষুধ কিনতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে শাহজাদপুর বাজারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ইমরান।’
শান্তা আক্তার জানান, ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ইমরান তাঁকে ও ছেলে ইয়াজ খলিফাকে (১৫ মাস) নিয়ে ঢাকায় আসেন। প্রথমে ফুটপাতে জুতার দোকান দেন। ২-৩ মাস ব্যবসা করার পর সেখানে টিকতে না পেরে যখন যে কাজ পেয়েছেন, তা করে কোনোরকমে সংসার চালিয়েছেন। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ইমরান খলিফা শাহজাদপুর খিলবাড়িটেক নামক স্থানে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। কষ্ট করেই চলত তাঁদের সংসার। এ মাসেই ইমরান নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি পান।
কাঁদতে কাঁদতে শান্তা আক্তার বলেন, ‘মোর কপালে সুখ সইল না, মোরে নিয়া ঢাকায় আইয়া কত কষ্ট করছে, যহন একটা চাকরি পাইল, হেই সময় আল্লাহ অরে নিয়া গেল। মুই এ্যাহন কি নিয়া বাঁচমু, কে মোর ছোট সন্তানকে মানুষ করবে। মুই ওর অফিসের যাওয়ার রাইতের খাবার রেডি কইররা বইয়া আছি, কই, ও তো আহে না।’
ইমরান নিহত হওয়ার বিষয়টি অফিস জানে কি না, জানতে চাইলে স্ত্রী শান্তা বলেন, ‘অফিসের স্যার মোরে ফোন দিয়া সান্ত্বনা দেছে এবং কইছে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঢাকায় যাইতে। আমার স্বামী গরিব মানুষ, সে রাজনীতি বোঝে না, আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই।’
ইমরানের বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শুক্রবার (১৯ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টার দিকে ইমরানের ফোন থেকে কল আসে। ডাক্তার পরিচয়ে একজন বলেন, “ইমরান খুবই অসুস্থ, ইউনাইটেড হাসপাতালে আছে।” পরে আমি ছেলের বউকে জানালে বউমা হাসপাতালে গিয়ে দেখে, অনেক লাশের সঙ্গে পড়ে আছে আমার বাবার লাশ। পরে সে ফোনে আমাকে জানায়, ইমরান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। বাবার কী যে কষ্ট হইছে, বাঁ পাঁজর দিয়ে গুলি ঢুকে ডান পাঁজর দিয়ে নাড়িভুঁড়িসহ বের হয়ে গেছে।’
ইমরান খলিফা সম্পর্কে জানতে চাইলে কালনা গ্রামের মো. জালাল সরদার (৭০) বলেন, ‘ইমরানকে ছোটবেলা থেকেই চিনি-জানি। সে খুবই নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। জোরে একটা কথাও বলতে শুনিনি কিংবা রাজনীতি করতে দেখিনি। এভাবে ছেলেটি মারা যাবে, ভাবতেও পারিনি।’