বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি পালপাড়া এলাকা থেকে গত রোববার বিকেলে রথযাত্রা বের হয়েছিল
বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি পালপাড়া এলাকা থেকে গত রোববার বিকেলে রথযাত্রা বের হয়েছিল

রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মৃত্যু

শিশু মণিকা খুঁজে ফিরছে মাকে, বাবাকে খুঁজছে অর্ণব-আরাধ্য

মায়ের সঙ্গে রথযাত্রায় গিয়েছিল শিশু সুস্মিতা (১০)। স্টিলের তৈরি রথের গম্বুজ বা চূড়ার সঙ্গে সড়কের ওপর বৈদ্যুতিক তারে লেগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় সে। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায় দুই দিন ধরে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে শিশুটি।

হাসপাতালে গতকাল মঙ্গলবার কথা হয় সুস্মিতার মা সমাপ্তি রানীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রথযাত্রায় হাজারো ভক্ত উপস্থিত ছিলেন। সুস্মিতা রথের কাছাকাছি ছিল। হঠাৎ মেয়েটার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। তারপর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুই দিন ধরে হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মেয়েটা। মাঝেমধ্যে ভয়ে আঁতকে উঠছে।’

বগুড়া শহরের স্টেশন সড়কের সেউজগাড়ি এলাকায় গত রোববার বিকেলে রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়। আহত হন অন্তত ৪৩ জন। রথযাত্রার আয়োজনে ছিল সেউজগাড়ি পালপাড়া আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন)। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে শহরের সেউজগাড়ি আমতলা মোড় অতিক্রম করার সময় রাস্তার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে রথের চূড়ার স্পর্শে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে।

নিহত ব্যক্তিরা হলেন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কলুপাড়ার নরেন্দ্র নাথ সরকারের ছেলে অলোক কুমার সরকার (৩৮), বগুড়া শহরের পুরান বগুড়া হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা লঙ্কেশ্বর চন্দ্র সরকারের স্ত্রী আতশি রানী (৪৫), আদমদীঘি উপজেলার কুন্দগ্রামের ভবানী মহন্তের ছেলে নরেশ মোহন্ত (৬০) ও বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার চেলোগ্রামের রঞ্জিতা মহন্ত (৬০)।

রথযাত্রা উৎসবে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আহত হয়েছে মনিকা (৮)। ওই ঘটনায় তার মা আতশি রানী মারা গেছেন। গতকাল মঙ্গলবার তোলা

শিশু মণিকা জানে না মা মারা গেছেন
মা আতশি রানীর হাত ধরে আট বছরের শিশু মণিকাও রথযাত্রায় গিয়েছিল। সেখানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান আতশি রানী। মায়ের হাত থেকে ছিটকে পড়ে প্রাণে রক্ষা পায় শিশু মণিকা। মায়ের সৎকার হয়েছে। মণিকা এখনো জানে না তার মা মারা গেছে। সারাক্ষণই সে মাকে খুঁজে ফিরছে। মণিকার বাবা লঙ্কেশ্বর পেশায় রাজমিস্ত্রির জোগালি (সহকারী)। মণিকার বড় বোন কণিকা রানী বলেন, ‘গতকাল মায়ের দেহ সৎকার করা হয়েছে। মণিকাকে মায়ের মৃত্যুর ঘটনা জানানো হয়নি। সে সব সময় মাকে খুঁজে ফিরছে।’

বাবাকে খুঁজছে অর্ণব ও আরাধ্য
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার আটমূল ইউনিয়নের কলুপাড়ার অলোক কুমার সরকার (৩৮) স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে বগুড়া শহরের পালপাড়া এলাকায় বসবাস করতেন। পেশায় ফ্রিল্যান্সার অলোক কুমার ইসকন মন্দিরের সেবকও ছিলেন। রথযাত্রায় রথ ওঠানো-নামানোর ফোল্ডিং করার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শ লাগার আগেই রথের চূড়া নিচে নামানোর কথা থাকলেও অসতর্কতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান তিনি।
স্বামীকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল অলোক কুমারের স্ত্রী শর্মিলা রানী। বড় ছেলে অর্ণব তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। মেয়ে আরাধ্যর বয়স দুই বছর। শর্মিলা বলেন, ‘ছেলে-মেয়ে দুজনই বাবাকে খুঁজছে। বাবার জন্য কান্নাকাটি করছে। অলোককে ছাড়া আমি কীভাবে বাঁচব? কীভাবে দুই সন্তানকে বড় করব?’

বগুড়া শহরের স্টেশন সড়কের সেউজগাড়ি এলাকায় গত রোববার বিকেলে রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়। আহত হন অন্তত ৪৩ জন।

স্বল্প আয়ে সংসার চলত নরেশ মোহন্তের
আদমদীঘি উপজেলার কুন্দগ্রামের নরেশ মোহন্তের সংসার চলত মৌসুমি কুমড়ার বড়ি বিক্রি করে। রথযাত্রায় যোগ দিতে গত রোববার আদমদীঘি থেকে স্ত্রী আরতি মোহন্তকে সঙ্গে করে বগুড়া শহরে আসেন নরেশ। এরপর বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান নরেশ; আহত হন আরতি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরতি মোহন্ত বলেন, ‘পুণ্যলাভের আশায় রথযাত্রায় আচ্চিলাম। মুহূর্তের সব শ্যাষ। নরেশকে ছাড়া সংসারটা চলবি ক্যামনে?’

মায়ের লাশ নিয়ে ফিরলেন চন্দনা
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার গোহাইল ইউনিয়নের চেলো গ্রামের সুদেব মোহন্তের স্ত্রী রঞ্জিতা মহন্ত এবং মেয়ে চন্দনা রানী (৩৫) রোববারের রথযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। দুর্ঘটনায় মা রঞ্জিতা মহন্ত মারা গেছেন। গত সোমবার মায়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন মেয়ে চন্দনা মহন্ত। চন্দনা বলেন, ‘আনন্দের রথযাত্রায় অংশ নিতে এসে চোখের নিমেষেই মা ছটফট করে মারা গেল। এ দৃশ্য ভুলব ক্যামনে?’

চলেই গেলেন জলি সাহা
সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার গান্দইল গ্রামের মেয়ে জলি সাহা। ধুমধাম করেই বিয়ে হয়েছিল তাঁর। সংসার আলো করে এসেছিল দুই ছেলেমেয়ে। তারা বর্তমানে কলেজে পড়ালেখা করছে। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে স্বামী মারা যায়। পরে তাঁর বিয়ে হয় সারিয়াকান্দি সদরের ব্যবসায়ী বাসুদেব সাহার সঙ্গে। রথযাত্রায় এসে মারা গেছেন জলি সাহা। স্বামী বাসুদেব বলেন, ‘চলেই গেলেন জলি। আমি এখন নিঃস্ব।’

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বগুড়া শহরের রাস্তার ওপর দিয়ে বৈদ্যুতিক তার থাকায় রথের চূড়ার উচ্চতা আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছিল প্রশাসন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, সড়কে বৈদ্যুতিক তারের অবস্থানভেদে রথের চূড়া ওঠানামা করা হবে। কিন্তু তেমনটি না করায় রথের চূড়ার সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার লেগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হতাহতের এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন ছাড়াও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় পৃথক কমিটি করেছে।