‘গণহত্যা’ দিবস পালন

মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার প্রত্যয় রোহিঙ্গাদের

রোহিঙ্গা ‘গণহত্যা দিবস’ উপলক্ষে বড় সমাবেশ হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে। আজ শুক্রবার বেলা ১১টায়
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করেছেন রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে দিবসের কর্মসূচিতে বৃষ্টি উপেক্ষা করে অংশ নেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। তাঁরা সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মানববন্ধন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নিজ জন্মভূমি রাখাইন রাজ্যে (আরাকান রাজ্য) ফিরে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। দুপুর ১২টার মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে সব কর্মসূচি শেষ হয়।

‘গণহত্যা’ দিবসের সবচেয়ে বড় সমাবেশ হয়েছে উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের খেলার মাঠে। সেখানকার সমাবেশে ২০-২৫ হাজার রোহিঙ্গার সমাগম ঘটে, যার অধিকাংশ কিশোর, তরুণ ও যুবক। হাত তুলে তাঁরা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। এ সমাবেশে বক্তব্য দেন আরাকান রোহিঙ্গা পিস ফর হিউম্যান রাইটসের সভাপতি জুবায়ের আহমদ, রোহিঙ্গা এফডিএমএন (ফোর্সিবলি ডিসপ্লেসড মিয়ানমার ন্যাশনালস) রিপ্রেজেনটেটিভ মোহাম্মদ কামাল, রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার ছৈয়দ উল্লাহ, মোহাম্মদ মুসা, মোহাম্মদ সুয়াইব প্রমুখ।

জুবাইর আহমদ বলেন, ‘আমরা দ্রুত মিয়ানমারের জন্মভূমিতে ফিরতে চাই। আমরা (রোহিঙ্গারা) সে ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ। মর্যাদার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গারা যেভাবে দল বেঁধে বাংলাদেশ পালিয়ে এসেছিল, ঠিক সেভাবে আবার বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য হবে।’

মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার দাবি জানান রোহিঙ্গারা। আজ শুক্রবার সকালে উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে

রোহিঙ্গা নেতা মাওলানা ছৈয়দ উল্লাহ (৫০) বলেন, ‘বাংলাদেশের এই আশ্রয়শিবিরে আমরা ছয়টি বছর কাটিয়ে দিয়েছি। এখন আর সে সুযোগ নেই। আমাদের ফিরে যেতে হবে নিজেদের জন্মভূমিতে। মর্যাদার সঙ্গে স্বাধীনভাবে ফেরার পথ (প্রত্যাবাসন) তৈরিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’ মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি কি না, জানতে চাইলে উপস্থিত সব রোহিঙ্গা হাত তুলে যেকোনো মুহূর্তে মিয়ানমার ফিরতে রাজি বলে ঘোষণা করেন।

একই সমাবেশে বক্তব্য দেন আরেক রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার আবুল কালাম (৫২)। তিনি ২৫ আগস্টের ‘গণহত্যা দিবসের’ প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, সেদিন আরাকানে (রাখাইনে) মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যেভাবে নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা জীবনেও ভুলতে পারবেন না। চোখের সামনে গুলি করে শত শত মা-বোন-ভাই-বন্ধুকে হত্যা করে গণকবর দিয়েছে। তবু তাঁরা আরাকানে ফিরতে চান। টেকসই, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা চান। তাঁরা বাংলাদেশে আর এক দিনও থাকতে চান না। এ সময় উপস্থিত রোহিঙ্গারা হাত তুলে তাঁর বক্তব্যের সহমত প্রকাশ করেন।

ছয় বছর ধরে আট লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মোহাম্মদ সোয়েব বলেন, এখানে (আশ্রয়শিবিরে) দীর্ঘ সময় ধরে থাকার সুযোগ সীমিত হয়ে আসছে। ঠিকানাবিহীন জাতি হিসেবে রোহিঙ্গারা আর ভিন্ন দেশে পড়ে থাকতে চান না। রোহিঙ্গাদের বিবেক, আত্মসম্মানবোধ আছে। রোহিঙ্গাদের উচিত দ্রুত নিজ দেশে ফিরে যাওয়া। আর সে জন্য দরকার রাখাইনে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। তাঁরা মর্যাদার সঙ্গে রাখাইনে ফিরতে চান।

বৃষ্টি উপেক্ষা করে সমাবেশে অংশ নেন রোহিঙ্গারা। আজ শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে

উখিয়ার কুতুপালং, মধুরছড়া, বালুখালী, জামশিয়া, টেকনাফের মূছনী, জাদিমুরা, শালবন, নয়াপাড়া আশ্রয়শিবিরেও গণহত্যা দিবস উপলক্ষে রোহিঙ্গাদের পৃথক সমাবেশ, শোভাযাত্রা ও মানববন্ধন হয়েছে। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এসব সমাবেশ থেকেও রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

কর্মসূচির শেষ দিকে রোহিঙ্গারা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনীর হাতে নিহত স্বজনদের ছবিসংবলিত পোস্টার, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। পরে চলে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। কিন্তু বিগত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। এখন চীনের মধ্যস্থতায় পাইলট প্রকল্পের আওতায় এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চলছে।

রোহিঙ্গা নেতা জামাল হোসেন বলেন, ২৫ আগস্ট গণহত্যা দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন জানতে পারে, সেদিন রাখাইনে কী ঘটেছিল। দিবসটি পালনের মাধ্যমে তাঁরা রাখাইনে সংঘটিত নৃশংসতা, হত্যাযজ্ঞ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার দাবি করছেন। রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের গ্রাম ধ্বংস, হত্যা, ধর্ষণ ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়ার যে গণহত্যা মামলা চলমান, সেটির রায়ও দ্রুত কার্যকর চান রোহিঙ্গারা।