‘ভাতের কষ্টে’ রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন সাহিদা

জীবিকার তাগিদে এই পেশাকে বেছে নিয়েছেন সাহিদা বেগম
ছবি: প্রথম আলো

চায়ের দোকানগুলোতে তখন সান্ধ্য আড্ডা জমে উঠেছে। অন্ধকার রাস্তায় চোখ আটকে গেল দূর থেকে ছুটে আসা ব্যাটারিচালিত এক রিকশার দিকে। ওই রিকশার চালকের আসনে বসে আছেন এক নারী। মাথায় ওড়না পেঁচানো। মুখে পরেছেন মাস্ক। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগনী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সামনে এই নারী রিকশাচালকের সঙ্গে দেখা হলো।

রিকশা থামিয়ে আলাপ জমল ওই নারীর সঙ্গে। জানালেন তাঁর নাম সাহিদা বেগম (৩৮)। সচরাচর মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার সড়কগুলোতে নারী রিকশাচালকের দেখা মেলে না। তবে সাহিদা ব্যতিক্রম। জীবিকার তাগিদে এই পেশাকে বেছে নিয়েছেন বলে জানালেন তিনি।

আক্ষেপের সুরে সাহিদা বলেন, ‘জন্মের পর থেইকা কষ্ট করতাছি। এক বেলা খাইলে আরেক বেলা না খাইয়া রইছি। খিদার জ্বালায় মাঝেমধ্যে মইরা যাইতে মন চাইত। বিভিন্ন জায়গায় সম্মান নিয়া কাজ করতে চাইছি। কিন্তু নিয়মিত কোনো কাজ পাই নাই। শেষ পর্যন্ত ভাতের কষ্টে রিকশা লইয়া রাস্তায় নামছি। এহন সম্মানের সাথে পরিশ্রম কইরা বাঁচতে চাই।’

বর্তমানে মায়ের সঙ্গে বজ্রযোগনী ইউনিয়নের আদর্শ গুচ্ছগ্রামে থাকেন সাহিদা। তাঁর বাবা নুর হোসেন অনেক আগেই মারা গেছেন। তাঁদের আদি নিবাস সদর উপজেলার গজারিয়াকান্দি এলাকায়। তবে প্রায় ১৫ বছর ধরে সাহিদার মা বজ্রযোগনী ইউনিয়নে বিভিন্ন সড়কের পাশে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকতেন। পরে সরকারি উপহার পাওয়া জমিতে বাড়ি বানিয়ে থাকেন তাঁরা।

ছোটবেলায় সাহিদার বাবা মারা যান। তখন সাহিদা ও তাঁর ছোট ভাই বেলালকে নিয়ে অথই সাগরে পড়েন মা রানু বেগম। সংসার চালাতে রানু বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। ৯ থেকে ১০ বছর সাহিদাও গৃহপরিচারিকার কাজ নেন। ২০০০ সালের দিকে ১৩ থেকে ১৪ বছর বয়সে সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়নে কামরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে সাহিদার বিয়ে হয়।

সাহিদা বলেন, ‘ভাবছিলাম বিয়ার পর কষ্টের দিন দিন শেষ হইয়া যাইব। বিয়ার পাঁচ বছর পর এক মাইয়া হইল। কিন্তু স্বামী ঠিকমতো কাজ করত না। একসময় মাদক খাওয়া শুরু করল। প্রতিদিন কারণে–অকারণে মারত। মাইয়ার বয়স যখন দুই বছর, তখন স্বামী আরেক বিয়া কইরা আমাগো ছাইড়া চইলা যায়। তাই আবার মাইয়াডারে নিয়া মায়ের সংসারে গিয়া উঠলাম। এর মধ্যে ছোট ভাই বিয়া কইরা আলাদা হইয়া গেছে।’

যাত্রীর অপেক্ষায় অন্য রিকশাচালকদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন সাহিদা

একাধিক পেশা পাল্টে আট দিন ধরে ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা চালাচ্ছেন সাহিদা। এর আগে কখনো অন্যের বাড়িত কাজ করেছেন। কখনো কারাখানায় শ্রমিকের কাজ করেছেন। তবে সংসারে সচ্ছলতা আসেনি। বছরখানেক আগে প্যাডেল রিকশা চালানো শুরু করেছিলেন সাহিদা। তবে অনেক পরিশ্রম করতে হয় বলে এক সপ্তাহ পরেই তিনি প্যাডেল রিকশা চালানো ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর কিছুদিন কারখানায় কাজ করে আবার বসেছেন চালকের আসনে।

আলাপের মধ্যেই ইউপি কার্যালের সামনেই সাহিদার মা রানু বেগমের (৭০) সঙ্গে দেখা হলো। বয়সের ভাড়ে তিনি ন্যুয়ে পড়েছেন। এখন আর কোনো কাজ করতে পারেন না। রানু বেগম বলেন, ‘রাস্তায় মাইয়া মানুষের কত ধরনে বিপদ থাকে। এর পরেও অভাবের কারণে মেয়ে রিকশা চালায়। না খাইয়া থাকমু, তাই বাধা দেই না। মেয়ের জন্য মনডা কান্দে, চিন্তাও হয়। এ জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে মাইয়ার বাড়ি অপেক্ষায় রাস্তায় বইসা থাকি। সাহিদা আইলে একসঙ্গে বাড়ি ফিরি।’

প্রতিদিন সকাল আটটার দিকে রিকশা নিয়ে বের হন সাহিদা। সারাদিন রিকশা চালিয়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হয়। তবে মহাজনকে প্রতিদিন জমা দিতে হয় ৪০০ টাকা। তাই দিনশেষে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন তিনি।

সাহিদার প্রতিবেশী ডলি বেগম বলেন, ‘সাহিদার পুরা জীবনটা কষ্টের। কোনো দিক দিয়েই সুখ নাই অর। এ রকম পরিবেশে একজন মেয়ের জন্য রিকশা চালানো তো সহজ না।’

গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘সাহিদা খুব কষ্টে জীবনযাপন করছিলেন। আমি তাঁকে রিকশা চালানোর ব্যাপারে উৎসাহ দেই। যেকোনো কাজ করাই সম্মানের—এটা বোঝানোর চেষ্টা করি। পরে আমার এক চাচার সঙ্গে কথা বলে তাঁকে একটি রিকশার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এখন সম্মানের সঙ্গে সাহিদা কাজ করছেন।’

সাহিদাকে এখন নিয়মিত পথে–ঘাটে দেখেন আরেক রিকশাচালক কামাল সৈয়াল। সাহিদার এই সংগ্রামী জীবন সবার জন্য অনুপ্রেরণার বলে মনে করেন তিনি। কামাল বলেন, রিকশা চালানো খুব কষ্টের কাজ। রোদে পুড়তে হয়, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। আবার রাত-বিরাতে ডাকাতের ভয় তো থাকেই। তবে এগুলো পেছনে ফেলে সাহিদা রিকশা চালাচ্ছে। হালাল উপার্জন করে সংসারের হাল ধরেছে। এটা অনেক সাহসের কাজ। তবে কেউ যদি সাহিদার জন্য একটা নিরাপদ কাজের ব্যবস্থা করতে, সেটা বেশি ভালো হতো।