দিনশেষে পাখিরা ঘরে ফেরে। সেই ঘর তো গাছ, গাছেরই ডালপালা। তবে সব গাছই পাখির ঘর হয় না। যেখানে নিরাপদ আশ্রয় আছে, মানুষের সঙ্গ, মমতা-ভালোবাসা আছে, পাখিরা সেরকম স্থান, গাছপালাকেই ঘর করে নেয়। সেখানে রাত কাটায়, বাসা বোনে।
এ রকমই মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের আজমেরুতে এরশাদ মিয়ার বাড়িটি পাখির আশ্রয়স্থল হয়েছে। সন্ধ্যা হলেই ওই বাড়িতে বক, পানকৌড়িসহ ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসে। তারা সেখানে রাত কাটায়। ভোরে আবার উড়ে চলে যায় খোলা প্রান্তরে, হাওর-বাঁওড়ের দিকে। গত কয়েক বছর ওই বাড়ির লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে পাখিগুলো থাকছে।
গত রোববার সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা যায়, ওই বাড়িতে পাখির মেলা বসেছে। সাদা-কালো রেখার মতো পাখিরা উড়ে আসছে। কখনো দল বেঁধে, কখনো এক-দুইটা করে। বাড়ির চারদিক খোলা। সবদিক থেকেই পাখি উড়ে আসে। আছে সাদা বক, পানকৌড়ি। আছে শালিক, ঘুঘু, বুলবুলি, ফিঙেসহ অচেনা ছোট ছোট পাখিরাও। অন্ধকার গাঢ় না হওয়া পর্যন্ত পাখিদের এই চঞ্চলতা চলতে থাকে।
ওই বাড়ির লোকজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, তিন-চার বছর ধরে আজমেরুর এরশাদ মিয়ার বাড়িতে পাখি আসছে। সারা বছরই কমবেশি পাখি থাকে বাড়িতে। তবে জ্যৈষ্ঠ মাসের দিকে বেশি থাকে। এ সময় পাখিরা বাড়ির পশ্চিমের দিকের পুকুরপাড়ে আম, তেঁতুলসহ অন্যান্য গাছে বাসা তৈরি করে। বাচ্চা ফোটায়। বক ও পানকৌড়িই বেশি। বাড়ির পুকুরটিও পাখিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পাখির মল পড়ে পুকুরের পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ কারণে পুকুরে মাছচাষও করা হয় না। খুব সকালেই ঘুম ভাঙার আগে থেকেই পাখিগুলো বাড়ি থেকে চলে যেতে শুরু করে। বাড়ির কাছেই খাইঞ্জার হাওর, হাইল হাওর, চারদিকে খোলা মাঠ। পাখিরা খাবারের সন্ধানে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। দিনে আর বাড়িতে ফিরে না। সন্ধ্যা যত কাছাকাছি আসে, পাখিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
বাড়ির মালিক এরশাদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে মারার লাগি কেউ কেউ আয় (শিকারের জন্য আসে)। রাতে পাহারা দিই। থানা থাকিও নম্বর (ফোন নম্বর) দিয়া গেছে। কইছে (বলেছে), কেউ দিগদারি (উৎপাত) করলে জানাইতে। তবে কিছুদিন ধরে শিকারিরা আর আয় (আসে) না। যতটুকু পারি, পাখির নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করি। হুরুত্বাইনতে যাতে ইটা না দেয় (বাচ্চারা যাতে ঢিল না ছুঁড়ে), এর জন্য বিকালে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করি।’
এরশাদ মিয়া আরও বলেন, ‘পাখিরা আমার ওখানো (বাড়িতে) থাকে। তারার নিরাপত্তা দেওয়া আমার কর্তব্য। ফলটল নষ্ট করে, তবু মনে করি যা থাকে, যা খাইতাম পারি। পাখিদের দেখাশোনাও সওয়াবের কাম (কাজ)।’
গ্রামের লোকজনও পাখির সুরক্ষায় কাজ করছেন। কলেজশিক্ষার্থী রাজিব আহমদ বলেন, ‘আগে কেউ কেউ পাখি শিকার করতে আসত। আমরা বাধা দিয়েছি। এখন আর কেউ আসে না। রাতে পাখি ওড়ার শব্দ হলে আমরা টর্চ লাইট নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। কেউ পাখি মারতে এল কিনা, বাড়িটির চারদিক ঘুরে দেখি।’
সংগঠক ও প্রতিবেশী গয়ঘর গ্রামের আমীর মিয়া বলেন, ‘তিন-চার বছর ধরে আজমেরুর এই বাড়িতে পাখি থাকে। বিকেলবেলা যেদিনই সময় পাই, ওই বাড়িতে ছুটে যাই।’