মুক্তিযুদ্ধ করেননি, এমন ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদে নিজের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা নেবেন না বলে জানিয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা দবিরুল ইসলাম। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত না করতে গতকাল রোববার জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন তিনি।
আবেদনপত্রে দবিরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার বহর দেখে চেতন মুক্তিযোদ্ধারা দুঃখিত, ব্যথিত, লজ্জিত ও অপমানিত। মৃত্যুর পর আর অপমানিত হইতে চাই না। আমাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করবেন না।’
যোগাযোগ করা হলে এর কারণ হিসেবে দবিরুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা এক দিনের জন্যও রাইফেল ধরেননি, আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়েছেন, এমন অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন। তাঁরাও রাষ্ট্রীয় সম্মান পাচ্ছেন। অথচ জীবন বাজি রেখে আমি যুদ্ধ করেছি। এখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে নিজেকে হারাতে বসেছি। মৃত্যুর পর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়া মানেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা। তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদেই আমার এ আবেদন।’
দবিরুল ইসলাম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ঠাকুরগাঁও জেলার সদস্য ছিলেন। এখন তিনি অবসরে আছেন। দবিরুল ইসলাম বলেন, ‘দিন দিন মুক্তিযোদ্ধার তালিকাটা বেড়েই চলছে। এই তালিকার পেছনেও রয়েছে নানা অনিয়ম। স্বাধীনতার পর থেকে এলাকায় প্রায় ১০০ অমুক্তিযোদ্ধা তালিকায় এসেছেন। এমন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাই এখন বেশি। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেননি, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেওয়া আমাদের (প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা) জন্য অপমানের।’
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া সম্মানী ভাতার বিষয়ে দবিরুল ইসলাম বলেন, ‘দুই ঈদ ও বৈশাখে যে ভাতা পাই, তা দিয়ে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মিষ্টিমুখ করাই। মাসিক ভাতাটাও ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি।’
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি ঠাকুরগাঁও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডর আবদুল মান্নান।
জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা। তাঁর (বীর মুক্তিযোদ্ধা দবিরুল ইসলাম) আবেদনটি আমি এখনো দেখিনি। আবেদনটি পেলে তাঁর সঙ্গে কথা বলব।’
২০২০ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান প্রদর্শন আদেশ জারি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আদেশে বলা হয়, কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানাতে হবে। ঢাকায় অবস্থানরত কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হলে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট-সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন। বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আত্মীয়স্বজন বা কোনো নাগরিক প্রশাসনকে অবহিত করতে পারবেন। এমনকি সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলেও যাচাই করে প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। মহানগর ও জেলা সদরে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা পর্যায়ে হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য সরকারের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করবেন। রাষ্ট্রীয় বা জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকলে জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পক্ষে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সরকারের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান প্রদর্শনের নিয়ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার কফিন জাতীয় পতাকা দ্বারা আবৃত্ত করতে হবে। তবে সৎকার বা সমাধিস্থ করার আগে জাতীয় পতাকা খুলে ফেলতে হবে। সরকারের অনুমোদিত প্রতিনিধি কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। অনুমোদিতসংখ্যক পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা সশস্ত্র সালাম প্রদান করবেন এবং বিউগলে করুণ সুর বাজাতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গার্ড অব অনার পরিচালনা করবেন। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় বা জনগুরুত্বপূর্ণ কাজের কারণে থাকতে না পারলে থানার পরবর্তী জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এ দায়িত্ব পালন করবেন। সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে উক্ত বাহিনীর নিজস্ব রীতি অনুসরণ করতে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ও ধর্মীয় নীতি অনুযায়ী সৎকার বা সমাধিস্থ করতে হবে। অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ করা অর্থ থেকে অনুদান প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।