সুনামগঞ্জ-১ আসনে এবার নৌকার মনোনয়ন পাননি ‘আলোচিত-সমালোচিত’ সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে রতন। তবে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন অনেকটা নীরবে। এবার নীরবতা ভেঙে ঘোষণা দিলেন, নির্বাচনে তিনি আছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়বেন। তাঁর ঘোষণার মধ্য দিয়ে নৌকার প্রার্থীর ‘শক্ত’ প্রতিদ্বন্দ্বী আরও একজন বাড়ল।
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও মধ্যনগর—এই চার উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে নির্বাচনী উত্তাপ অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়ে। এক বছর ধরেই আওয়ামী লীগের ‘ধনে-জনে’ শক্তিশালী কয়েকজন দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে সক্রিয় ছিলেন। বড় বড় সভা-সমাবেশ, শোডাউন করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বর্তমান সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন, সুনামগঞ্জ-সিলেট সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য শামীমা আক্তার খানম, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রনজিত চন্দ্র সরকার, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও জেলা শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি সেলিম আহমদ। তাঁদের মধ্যে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পেয়েছেন রনজিত চন্দ্র সরকার। তিনি তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা। গত নির্বাচনেও দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়ে মাঠে ছিলেন। এবার তিনি দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর দলের অনেক নেতাই এখন নৌকার পক্ষে মাঠে নেমেছেন। তবে নৌকা না পেলেও মাঠ ছাড়েননি মোয়াজ্জেম হোসেন ও সেলিম আহমদ।
মোয়াজ্জেম হোসেনের নির্বাচনে লড়ার ঘোষণায় এই আসনে দলের ‘শক্তিশালী’ দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে মোকাবিলা করতে হবে রনজিত সরকারকে। এতে নৌকা চাপে পড়তে পারে বলে মনে করেন অনেকেই।
মোয়াজ্জেম হোসেন গত বৃহস্পতিবার তাঁর নিজের বাড়িতে কর্মী–সমর্থকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করেন। সেখানে তিনি নির্বাচনী এলাকার দলীয় নেতা-কর্মী ও সুধীজনদের আগ্রহে তাঁকে নির্বাচন করতে হবে বলে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, তাঁর নির্বাচন নৌকার বিরুদ্ধে নয়; সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাস্তানির বিরুদ্ধে। এই সন্ত্রাসী, মাস্তান কে বা কারা, সেটি তিনি স্পষ্ট করেননি।
এই আসনে অন্য প্রার্থীরা হলেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ কংগ্রেসের নবাব সালেহ আহমদ, জাতীয় পার্টির আবদুল মান্নান তালুকদার, তৃণমূল বিএনপির মো. আশরাফ আলী, গণফ্রন্টের মো. জাহানুর রশিদ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) মো. হারিছ মিয়া।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নৌকা প্রতীক পাওয়ার পর দলের নেতাদের অনেকেই রনজিত সরকারের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন খান, সাধারণ সম্পাদক অমল কান্তি কর, ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদ গত ১৫ বছর মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা এখন রনজিত সরকারের পক্ষে সক্রিয়। তবে আওয়ামী লীগের নেতাদের একটা অংশ এখন ‘নীরব’ আছেন। তাঁদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ কেউ তলেতলে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
দলের নেতা-কর্মীরা জানান, ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগে উঠে আসা রনজিত সরকারের রাজনীতি সিলেটকেন্দ্রিক। এলাকায় মূলত নির্বাচন, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে তিনি আসেন। তবে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল সব সময়ই। অন্যদিকে মোয়াজ্জেম হোসেন টানা তিনবারের সংসদ সদস্য। নির্বাচনী এলাকার সবখানেই তাঁর অবস্থান আছে। নিজের বলয় আছে চার উপজেলাতেই। এটিকে তাঁর বিরোধীরা বলেন, ‘এমপি লীগ’। তিনি সবাইকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। সেলিম আহমদও নির্বাচনী চিন্তা মাথায় রেখে মাঠে আছেন অনেক দিন ধরেই। তাহিরপুর উপজেলায় তাঁর বাড়ি। তরুণদের নিয়ে তিনি পুরো নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়িয়েছেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, রনজিত সরকারের বড় শক্তি নৌকা ও দল। এটিকে তিনি কাজে লাগানোর চেষ্টায় আছেন। অন্যদিকে মোয়াজ্জেম হোসেন তিনিবারের টানা সংসদ সদস্য। নির্বাচনী এলাকার সব প্রান্তে তাঁর যোগাযোগ আছে। সেলিম আহমদও নানাভাবে এলাকায় সক্রিয়। স্বতন্ত্র দুজনই আবার এলাকায় ‘টাকাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত। যে কারণে তিনজনই নির্বাচনী মাঠে শক্ত প্রভাব ফেলার চেষ্টায় আছেন।
ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলের ৯০ ভাগ নেতা-কর্মী নৌকার প্রার্থীর পক্ষে। দলের নেতা-কর্মীদের নৌকার বাইরে যাওয়া সুযোগ নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে হাতে গোনা যে দু-একজন আছেন, তাঁরাও নৌকার পক্ষে চলে আসবেন।’
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জামালগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা রেজাউল করিম সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি। তিনি বলেন, দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন উন্মুক্ত। স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে যেতে বাধা নেই। যাঁর যে প্রার্থীকে ভালো লাগবে, তাঁর পক্ষেই থাকবে। সুতরাং এখানে নৌকার বিরোধিতা বলে কিছু নেই।
স্বতন্ত্র প্রার্থী সেলিম আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কারও বিরুদ্ধে বলব না। আমি মাঠে আছি, মানুষের কাছে যাচ্ছি। ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। কার জনপ্রিয়তা কতটুকু, সেটা ভোটেই প্রমাণিত হবে।’
আওয়ামী লীগ প্রার্থী রনজিত সরকার বলেছেন, ‘আমি সাধারণ মানুষ। দলের সভানেত্রী আমাকে নৌকা দিয়েছেন। মানুষের ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। দলের সবাই আমার সঙ্গে আছেন।’