শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়নি, লিখিত অভিযোগ দিতে বলল প্রশাসন

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহত মুকুল আহমেদ হাসপাতালে তাঁকে দেখতে আসা সহপাঠীদের কাছে হামলার বর্ণনা দিচ্ছেন। গতকাল শনিবার রাতে
ছবি: প্রথম আলো

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মুকুল আহমেদের ওপর হামলার ঘটনায় এখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত কমিটি হয়নি। গতকাল শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. খোরশেদ আলমসহ একটি দল হাসপাতালে যায় এবং মুকুলের চিকিৎসার খোঁজ নেয়।

মুকুল আহমেদ আজ রোববার সকালে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম, হল প্রাধ্যক্ষ মো. আরিফ হোসেন ও ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান তানখীর কায়সার হাসপাতালে এসে তাঁর খোঁজ নিয়েছেন। তাঁরা ঘটনার বর্ণনা শোনেন। পরে তাঁরা ঘটনার কথা উল্লেখ করে উপাচার্য, প্রক্টর, প্রাধ্যক্ষ ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান বরাবর পৃথক লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। বিষয়টি তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দেন তাঁরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মুকুলের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছি। তাঁকে আমরা লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি। একই সঙ্গে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য কিছু নগদ সহায়তা দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও সহায়তা দেওয়া হবে এবং উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন হলে তার জন্যও সহায়তা দেওয়া হবে। ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। অভিযোগ দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করে দোষী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’

গত বৃহস্পতিবার রাতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের ৪০১৮ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুকুল আহমেদকে রাতভর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ করেছেন তিনি। পিটিয়ে তাঁর বাঁ হাত ভেঙে দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

মুকুল আহমেদের অভিযোগ, ইংরেজি বিভাগের অষ্টম ব্যাচের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তানজিদ মঞ্জু ও সিহাব উদ্দিন এই নির্যাতন চালিয়েছেন। তাঁরা মুকুলকে বঙ্গবন্ধু হলের ৪০১৮ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে বেদম মারধর করেন।

এর আগে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মী আয়াত উল্লাহকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গুরুতর জখম এবং পায়ের রগ কেটে পঙ্গু করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে মঞ্জু ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে। গত ৫ আগস্ট গভীর রাতে ছাত্রলীগের হেলমেট পরা একটি পক্ষ ওই হামলা করেছিল।

তানজিদ মঞ্জুর দাবি, ‘ওই ছেলে (মুকুল) নীরবে শিবির করে। আমার ছোট ভাইদের বলেছিলাম ওকে ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে সতর্ক করার জন্য। আমার ছোট ভাইয়েরা ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে সতর্ক করেছে মাত্র। মারধর করেনি। কোথাও পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে গেছে, এখন আমাকে ফাঁসানোর জন্য সেটা ব্যবহার করছে।’

ঘটনার বিষয়ে মুকুলের ভাষ্য, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টিউশনি করে তিনি হলে ফিরছিলেন। পথে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডে দেখা হয় ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের কয়েক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। মুকুল তাঁদের কাছে জানতে চান, রাতে তাঁরা ক্যাম্পাসে যাচ্ছেন কেন। ওই শিক্ষার্থীরা বলেন, দশম ব্যাচের (দ্বিতীয় বর্ষ) বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধু হলে ডেকেছেন। পরে মুকুল হলে ফিরে তাঁদের দশম ব্যাচের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি বার্তা দেন এবং লেখেন, ‘আমাদের ব্যাচের নামে ছোট ভাইদের ডাকা হয়েছে, অথচ আমরা জানি না। আগেও এভাবে ডেকে র‍্যাগিং করা হয়েছে অনেককে। তখন বিভাগের শিক্ষকদের কাছে আমাদের কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। এখন আবার ডাকা হয়েছে। আমরা জানি না। এটা বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছুই না।’ এর কিছুক্ষণের মধ্যে তানজিদ মঞ্জু তাঁকে ফোন করে শের–ই–বাংলা হলের দিকে যেতে বলেন। রাত আটটার দিকে মুকুল বঙ্গবন্ধু হলের পাঁচতলার নিজের কক্ষ থেকে চতুর্থ তলায় নামতেই তানজিদের সঙ্গে দেখা হয় এবং সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় চতুর্থ তলার ৪০১৮ নম্বর কক্ষে। তানজীদ ও তাঁর সহযোগী সিহাব তাঁকে কিলঘুষি, লাথি এবং একপর্যায়ে জিআই পাইপ, ভাঙা চেয়ারের কাঠের হাতল দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেন। তিনি জ্ঞান হারালে ওই কক্ষে তাঁকে ফেলে রেখে বাইরে দিয়ে তালা দিয়ে চলে যান তাঁরা। গত শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের কর্তব্যরত ইন্টার্ন চিকিৎসক মো. নাহিদ বলেন, রোগীর (মুকুল) বাঁ হাতের হাড় ভেঙে গেছে। আপাতত ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে। ২১ দিন পর ব্যান্ডেজ খোলা হবে। এরপর হাড় জোড়া না লাগলে তাঁর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে।

মুকুলের বাড়ি নরসিংদী সদরে। তাঁর বাবা কাঠমিস্ত্রির সহকারীর কাজ করে সংসার চালান। তাঁরা দুই ভাই ও ছয় বোন। মুকুল টিউশনি করে নিজের ও এক বোনের পড়াশোনার খরচ চালান। মুকুল এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চান, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমনটা না ঘটে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. খোরশেদ আলম বলেন, এত দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো ছিল দুই দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। সেসব ঘটনার তদন্তকালে দেখা গেছে, দুই পক্ষের মীমাংসা হয়ে গেছে। কিন্তু মুকুল একেবারেই নিরীহ এক শিক্ষার্থী। তাঁর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। এমন একটি ঘটনায় ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ঘটনায় শাস্তি নিশ্চিত করে প্রশাসন বার্তা দিতে চায়।