টাকার অভাবে কখনো পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। জীবিকার তাগিদে বেছে নিতে হয়েছে মাঠে দিনমজুরি কিংবা কাপড় সেলাইয়ের কাজ। তারপরও পড়াশোনা চালিয়ে গেছে রংপুরের সুমাইয়া, নাটোরের রোকসানারা। কঠোর অধ্যবসায়ের ফলও পেয়েছে তারা। এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে পরিবারে খুশির উপলক্ষ নিয়ে এলেও কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কলেজের খরচ জোগাড় করা নিয়ে।
রঙের কাজ করে সাহেদ আলী যে আয় করেন, তা দিয়ে চার সদস্যের সংসার চলে না। এসএসসির ফরম পূরণের সময় তাই সাহেদ আলী মেয়ে সুমাইয়া আক্তারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, আর পড়াতে পারবেন না। তবে প্রতিবেশী ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় ফরম পূরণ করে পরীক্ষা দেয়। প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, জিপিএ-৫ পেয়েছে সুমাইয়া।
সুমাইয়ার বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার পাটোয়ারীপাড়া গ্রামে। সাহেদ আলী জানান, তিন শতাংশ জমির ওপর দুইটা টিনের ঘর। সব সময় রঙের কাজ থাকে না। যখন কাজ পান, তখন ৪০০ টাকা দিনে কামাই হয়। এই টাকায় বৃদ্ধ মায়ের ওষুধসহ সংসারের খরচ চালাতে পারেন না। তাই মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। সাহেদ বলেন, ‘গ্রামের লোক কয়ছে ওয় ভালো রেজাল্ট করছে। ভালো কলেজোত ভর্তি করা নাগবে। কিন্তু মোর তো চাল আনতে তরকারি জোটে না। ওক কেমন করি পড়াইম।’
সুমাইয়া আক্তার বলে, ‘আমি লেখাপড়া শেষ করে চিকিৎসক হতে চাই। কিন্তু বাবার আর্থিক সচ্ছলতা নেই। তবুও বাবা অনেক কষ্ট করে আমাকে পড়ানোর চেষ্টা করেছে। জানি না, আমার লেখাপড়া কত দূর পর্যন্ত যাবে।’
ডাঙ্গীরহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন, সুমাইয়া সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করবে।
সরামিনা ইয়াসমিনের বয়স যখন দুই বছর, তখন তার মা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। কয়েক বছর পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। মাকে নিয়ে সরামিনার ঠাঁই হয় ফুফু নুরজাহান খাতুনের বাড়িতে। সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে নিজের খরচ জুগিয়েছে। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে সরামিনা।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হায়বাদপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম ও সেলিনা আক্তার দম্পতির ছোট মেয়ে সরামিনা। সে জানায়, বাবা ছিলেন দরজি। বাবার কাছ থেকে ছোট থেকেই সে হাতের সেলাই ও ছোট ছোট পোশাক বানানোর কাজ শিখেছিল। বাবা দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে অন্যত্র চলে গেলে সে সেলাইয়ের কাজ বেছে নেয়। ষষ্ঠ শ্রেণির পর থেকে সেলাইয়ের কাজ করেই সে পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছে। তার আগ্রহ ভবিষ্যতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া। সে জন্য ভালো কোনো কলেজে ভর্তি হতে চায়। কিন্তু কলেজে পড়ার খরচ জোগাড় করা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে।
জোবেদা সোহরাব মডেল একাডেমির প্রধান শিক্ষক আব্দুস সাত্তার বলেন, ন্যূনতম পারিবারিক সাহায্য না পেয়েও নিজের চেষ্টায় এত দূর এসেছে সরামিনা। ভালো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর মানুষের একটু সহায়তা তার লক্ষ্য পূরণের পথকে মসৃণ করতে পারে।
অভাবের সংসারে খাওয়া-পরা নিয়ে চিন্তা থাকলেও পড়ালেখায় খুবই ভালো সেজযতি মাহাতো। মাঠে দিনমজুরি করা মায়ের আয়ে চলতে হয় তাকে। মায়ের সঙ্গে মাঝেমধে৵ তাকেও দিনমজুরি করতে হয়। সেজযতি এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
সেজযতি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার সোনাখাড়া ইউনিয়নের কলিয়া গ্রামের নিতাই চন্দ্র মাহাতো ও করুনা রানী মাহাতোর মেয়ে। ২০১১ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পরে করুনা রানী মাহাতো দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে দুঃখের সাগরে ভাসতে থাকেন। ছেলেরা বড় হয়ে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। মেধাবী মেয়েকে নিয়ে এই মা এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
বসতঘরটি থাকার অযোগ্য হয়ে পড়লে সরকারি সহায়তায় নতুন ঘর পেয়েছে সেজযতি ও তার মা। থাকার ব্যবস্থা হলেও জীবনে চলা আর পড়ালেখার উপায় খুঁজতে হয়রান মা ও মেয়ে। করুনা রানী মাহাতো বলেন, পড়ালেখার খুব আগ্রহ মেয়েটার। খেয়ে না খেয়ে এত দূর এসেছে।
সেজযতি মাহাতো বলে, পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষক হতে চায় সে। এ জন্য উচ্চমাধ্যমিকে ভালো একটা কলেজে পড়তে চায় সে।
নিমগাছি কলেজের ইতিহাস বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক সঞ্জীব কুমার মাহাতো বলেন, সেজযতি মাহাতো সেতুর স্বপ্ন পূরণে হৃদয়বান মানুষের সহায়তা প্রয়োজন।
দিনমজুরির পাশাপাশি বর্গা জমি চাষাবাদ করে ভালোই চলছিল আবদুল কুদ্দুস গাজীর সংসার। তিন মেয়ের খাওয়া-পরা নিয়ে ভাবতে হয়নি তাকে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দুই বছর ধরে শয্যাশায়ী কুদ্দুস। এরপর থেকে আর বড় মেয়ে রোকসানা আক্তারকে পড়াশোনার খরচ দিতে পারেননি। পাড়ার শিশুদের প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচ চালিয়েছে সে। এভাবে পড়াশোনা করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে রোকসানা।
রোকসানার বাড়ি নাটোর সদর উপজেলার আগদিঘা গ্রামে। এমন সাফল্যের পরও মেয়েকে বিয়ে দিতে পাত্র খুঁজছেন কুদ্দুস গাজী। কারণ জানতে চাইলে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ওকে বিয়ে দিলে পরিবারের কিছুটা খরচ তো কমবে। হয়তো মেয়েটার খাওয়া–পরার অভাব হবে না।
তবে রোকসানা আক্তার বলছে, সে এখন বিয়ে করতে চায় না। ডাক্তারি পড়তে চায়। রোকসানার মা জরিনা বেগম বলেন, রোকসানার বাবা অসুস্থ হওয়ার পর বাড়ির সঙ্গে একটা টং দোকান দিয়েছেন। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করেন। এভাবে কোনোরকমে বেঁচে আছেন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা, রহিদুল মিয়া, তারাগঞ্জ, রংপুর, সাজেদুল আলম, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও মুক্তার হোসেন, নাটোর]