কৃষিভিত্তিক পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে আসছিলেন উদ্যোক্তা সোহেল রানা। চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার শুরু থেকে পরিকল্পনা ছিল, বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের পাশাপাশি নানা উপযোগিতা তৈরি করে দর্শনার্থী টানার। এর শুরুটা হয়েছিল ১০৫ বিঘা পতিত জমি ইজারা নেওয়ার মধ্য দিয়ে। ২০১৮ সালে ওই জমি ইজারা নিয়ে মিশ্র ফলের বাগান গড়ে তোলেন তিনি।
সোহেল রানার বাগানে সবচেয়ে বেশি রয়েছে আমগাছ। এ ছাড়া বরই, মাল্টা, ড্রাগনসহ দেশি-বিদেশি শতাধিক ফলের গাছ তো রয়েছেই। দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে বাগানে বাহারি ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছ লাগিয়েছেন তরুণ এই উদ্যোক্তা। সেই সব ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছ এখন আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে।
নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে সাপাহার উপজেলার গোডাউনপাড়া এলাকায় সোহেল রানার ফলবাগান। নাম বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্ক। বাগানটিতে প্রথমবারের মতো পাপড়ি মেলেছে অভিজাত ফুল হিসেবে পরিচিত গ্ল্যাডিওলাস।
এখন তাঁর বাগান দেখতে অনেক দর্শনার্থী আসছেন জানিয়ে সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে কৃষি পর্যটন আরও বিস্তৃত। সেখানে সাপ্তাহিক ছুটিতে মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে সময় কাটাতে যান। ফেরার সময় শাকসবজি, ফলফলাদি অনেক কিছু নিয়ে ফেরেন। কৃষিপ্রক্রিয়ায় সঙ্গেও বড়-ছোট সবার পরিচয় ঘটে।
কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে পড়াশোনা শেষে একটি জাতীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কৃষিকাজে যুক্ত হন। সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে ২০২১ সালে জাতীয় যুব পুরস্কার অর্জন করেন তিনি।
দেশে সবচেয়ে আম উৎপাদন হওয়া জেলার মধ্যে একটি নওগাঁ। জেলার পোরশা, সাপাহার, পত্নীতলা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় বছর বছর বাড়ছে আমবাগানের সংখ্যা ও পরিসর। এমন জেলায় সোহেল রানার এই উদ্যোগকে প্রশংসনীয় বলছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁর প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এ কে এম মনজুরে মওলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে নিয়ে গাছপরিচিতি ও চাষের কৌশল সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কৃষি পর্যটন এলাকা হিসেবে বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের খুব ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।’
বরেন্দ্র অ্যাগ্রো ট্যুরিজমের প্রধান ফটক পেরোলে পথের দুই পাশে সারি সারি গাছে ফুটে থাকা বাহারি সব ফুল আমন্ত্রণ জানায়। একটু সামনে এগোতেই চোখে পড়ে গোলচত্বর, যেটা ঘিরে বিভিন্ন ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছে দৃষ্টি আটকে যায়। গোলচত্বরের পাশেই প্রায় দুই শতাংশ জায়গাজুড়ে একটি স্থানে টবে বিভিন্ন ধরনের ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছ লাগানো। পলি হাউসের সঙ্গে টিনের শেডের সঙ্গে বোতলে ঝুলছে শোভাবর্ধনকারী গাছ। বাগানের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বাঁশ ও খড়ের চালার নিচে বসার স্থান।
বাগানের ঢুকেই চোখ জুড়িয়ে গেল। আমের মুকুলের পাশাপাশি চারদিকে রঙের ছড়াছড়ি। ৯৩ জাতের শোভাবর্ধনকারী গাছ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্যাকটাস, অর্কিড, নীল অপরাজিতা, বনসাই, গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস। বাগানের প্রধান ফটকের কাছে গড়ে তোলা হয়েছে পলিনেট হাউস। যেখানে সবজি ও ফুলের চাষ করা হয়। এই হাউসেই প্রথমবারের মতো পাপড়ি মেলেছে গ্ল্যাডিওলাস ফুল।
বাগান ঘুরে দেখাতে দেখাতে সোহেল রানা বলেন, বাগানে সবচেয়ে বেশি আছে আম্রপালি জাতের আমগাছ। পাশাপাশি বারি আম-৪, বারি-১১, গৌড়মতি, কাটিমনসহ দেশি-বিদেশি প্রায় ৫০ ধরনের আমগাছ আছে। বিদেশি ফলের মধ্যে রয়েছে প্যাসন, অ্যাভাকাডো, ড্রাগন, মালবেরি, ত্বিন ফল। বইচি, অরবরই, খুদিজাম, আঁশফলসহ ১১ প্রকার বিলুপ্ত ফল ও ২২ প্রকারের ভেষজ গাছ রয়েছে বাগানে। এত দিন শোভাবর্ধনকারী গাছ বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও চারা বিক্রয়ের জন্য চাষ করা হতো। এই প্রথম পলিনেট হাউসে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করেছেন।
বাগানে দেখা হয় বেলাল হোসেন নামের এক দর্শনার্থীর সঙ্গে। নওগাঁ শহর থেকে সপরিবার বাগানটি দেখতে এসেছেন এই ব্যাংক কর্মকর্তা। বাগান ঘুরে মুগ্ধ এই দর্শনার্থী বলেন, ‘সোহেল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই। পত্রিকায় তার বাগানের কথা অনেক পড়েছি। ছুটির দিন হওয়ায় স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে দেখতে এলাম। বাগানের বিভিন্ন ফল, ফুল ও শোভাবর্ধনকারী গাছের সৌন্দর্য দেখে ভালো লাগল। বরই পেড়ে খেলাম। সবচেয়ে ভালো লাগল গ্ল্যাডিওলাস ফুল দেখে। বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েকটা গ্ল্যাডিওলাস ফুল কিনলাম।’
বেলালের কলেজপড়ুয়া মেয়ে সাবিলা আক্তার বলেন, ‘এই বাগানে এসে মনে হলো আমি যেন কোনো স্বর্গের রাজ্যে প্রবেশ করেছি। নতুন নতুন গাছের নাম জানলাম। পার্কের চেয়েও সুন্দর।’