১৯৩৩ সালে কুষ্টিয়ায় প্রতিষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ লাঠিয়াল সমিতি (বর্তমান নাম বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী) ১৯৭৩ সালে লাঠি-লড়ি-সড়কি বইটি প্রকাশ করে। দাম ৪ টাকা। সেই বই থেকে শুরু করে ২০০৭ সালে প্রকাশিত ক্রীড়া সাংবাদিক উৎপল শুভ্রর লেখা বিশ্ব যখন ফুটবলময় পর্যন্ত কী নেই এই পাঠাগারে। বাংলাদেশ থেকে প্রথম বক্সিংয়ে ব্রোঞ্জ পাওয়া মোশাররফ হোসেনকে ১৯৮৯ সালের পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান নৈশভোজের জন্য যে দাওয়াতপত্র দিয়েছেন, আছে তা-ও। আছে ১৯৯৮ সালে চীনের তৈরি ফুটবল আকৃতির রেডিও এবং হুবহু ফুটবল বিশ্বকাপের ট্রফির মতো দেখতে রেডিও। তাতে মেমোরি কার্ড ভরে গানও শোনা যায়।
ক্রীড়াজগতের বিচিত্র সংগ্রহে ঠাসা এই প্রতিষ্ঠানের নাম ‘শেখ মনিরুল আলমগীর ক্রীড়া পাঠাগার ও সংগ্রহশালা’। রাজশাহী নগরের শাহ্ মখদুম এলাকার পবা নতুনপাড়া মহল্লায় যার অবস্থান। ১৯৯৭ সাল থেকে তিল তিল করে গড়ে তোলা এ পাঠাগার এখন ক্রীড়া প্রকাশনার একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। পাঠাগারের পরিচালক মনিরুল আলমগীর বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের নির্বাহী সদস্য। সেই সঙ্গে তিনি রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য।
মনিরুল আলমগীর গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নিয়েছেন। নিজের চারতলা বাড়ির নিচতলা এই পাঠাগারের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, এটিই দেশে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র ক্রীড়া পাঠাগার। এই পাঠাগারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে আটটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়। পাঠাগারের প্রতিনিধিদল চীন, ভারত ও ভিয়েতনামে শুভেচ্ছা সফর করেছে। এখানে এসেছে চীনের প্রতিনিধিদলও। পাঠাগারের সদস্য এখন ২৫০ জন। তাঁদের জন্য বার্ষিক চাঁদার পরিমাণ ১ হাজার টাকা। উপদেষ্টা সদস্যদের চাঁদার পরিমাণ বছরে ৫ হাজার টাকা।
সরেজমিনে একদিন
সম্প্রতি পাঠাগারে গিয়ে দেখা যায়, ১০ জন পাঠক নিবিষ্ট মনে পড়ছেন। তাঁদের মধ্যে অশীতিপর আবুল কালাম বাদশা সবচেয়ে প্রবীণ পাঠক। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরচর্চা শিক্ষা বিভাগের পরিচালক হিসেবে ২০০৭ সালে অবসর নিয়েছেন। তিনি দেখছিলেন ১৯৭৬ সালের ‘চতুর্দশ আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা’র স্মরণিকা। তিনি বললেন, ক্রীড়াজগতের খবর রাখা তাঁর নেশা। এই পাঠাগারের সংগ্রহ দেখেই অবাক লাগে। সেই ভালো লাগা থেকেই এখানে আসা-যাওয়া।
আরেক নিবিষ্ট পাঠক রাজশাহী সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক আবু সালেহ মোল্লাহকেও পাওয়া গেল সেখানে। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকেই নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন বলে জানালেন। তিনি পড়ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন প্রকাশিত এশিয়ান কাপ-৭৯-এর স্মরণিকা।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন আটজন শিক্ষার্থী। তাঁরা কেউ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী, আবার কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের একেকজন একেক ধরনের বই ও স্মরণিকার পাতা ওলটাচ্ছেন। কারও হাতে ১৯৮৯ সালে সেবা প্রকাশনী প্রকাশিত মাসুদ মাহমুদের লেখা বই ফুটবলরঙ্গ, ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত কাজী আবদুল আলীর লেখা বই বিশ্বসেরা খেলা অলিম্পিক, ২০০১ সালে প্রকাশিত বরণকুমার চক্রবর্তীর লেখা বাঙলার লোকক্রীড়া, বিশ্ব যখন ফুটবলময় ইত্যাদি বইপুস্তক। আনজানা ফারহা এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর হাতে দেখা গেল শেখ মোহাম্মদ সাহেব আলীর লেখা ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ফুটবলের নায়ক হতে হলে বইটি।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যত ধরনের স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছে, তার বিরাট একটি সংগ্রহ মনিরুল আলমগীরের রয়েছে। একইভাবে দেশে প্রকাশিত ক্রীড়াসংক্রান্ত বাংলা বইয়ের সিংহভাগ রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। আছে বিদেশি বইও। ক্রীড়াকেন্দ্রিক প্রাচীন মূল্যবান (অ্যান্টিক) বহু বস্তুও আছে তাঁর সংগ্রহে। বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিপুল ভান্ডার, দেশে-বিদেশে যেখানে গেছেন, ক্রীড়াসংক্রান্ত যত ধরনের কার্ড পেয়েছেন, সব তাঁর পাঠাগারের পাঠকদের জন্য নিয়ে এসেছেন। পাশাপাশি সাধারণ পাঠকদের জন্যও এই পাঠাগার সমৃদ্ধ। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলা সাহিত্যের সব ধরনের বই রয়েছে এখানে। আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ বড় বড় লেখকের বইয়ের গ্যালারি।
শুধু পাঠাগারেই সীমাবদ্ধ নেই
মনিরুল আলমগীর এই প্রতিষ্ঠানকে শুধু পাঠাগারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; রাজশাহী মেট্রোপলিটন ক্লাব ও রাজশাহী দাবা একাডেমি নামে দুটি অঙ্গসংগঠনও করেছেন। রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজনে মেট্রোপলিটন ক্লাব বাস্কেটবলের প্রিমিয়ার ডিভিশন ও দাবা একাডেমি প্রথম বিভাগ খেলে। এই পাঠাগারের প্রতিনিধিদল চীনের কুনমিং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি আয়োজিত ‘সাউথ অ্যান্ড সাউথ ইস্ট এশিয়ান স্পোর্টস অ্যান্ড কালচারাল উইকে’ তিনবার যোগ দিয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরেও তারা এ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চীনে যাবে। তারা আয়োজকদের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে থাকে। এর আগে তারা ভারতের ভুবনেশ্বরে কেআইআইটি ইন্টারন্যাশনাল দাবা টুর্নামেন্টে ও ভিয়েতনামের থাই নুয়েন ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আয়োজিত সেমিনারে যোগ দিয়েছে। ২০১৯ সালে চীনের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল এই পাঠাগার পরিদর্শনে এলে তাদের সৌজন্যে একটি দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে ৩০ জন দাবাড়ুকে পুরস্কৃত করা হয়।
মনিরুল ইসলাম বলেন, তিনি ১৯৮৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সে সময় কোনো কাজ ছোট নয়—এটা প্রমাণ করার জন্য ছয় বন্ধু মিলে রাজশাহী শহরে মানুষের জুতা পলিশ করেছিলেন। সেই উদ্যম থেকেই পরে এই সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, ক্রীড়াবিষয়ক ম্যাগাজিন ও বইপুস্তক সংগ্রহের নেশা তাঁর অনেক আগে থেকে। ক্রীড়াসংক্রান্ত একটি দুর্লভ কিছুর খবর পেলে সেটির পেছনে ছুটতে গিয়ে কষ্টকে কষ্ট মনে করেননি। অকাতরে খরচ করেছেন। শুধু ভেবেছেন, মানুষের কাজে লাগবে একটা কিছু যদি করে যেতে পারেন। তবে তাঁর মৃত্যুর পর এই প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলবে, এখনো ঠিক করেননি সেটি।
পাঠাগারটির আছে একটি পরিদর্শন বই। সেখানে বেতার ও টেলিভিশনের জাতীয় ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার মো. জামিলুর রহমান লিখেছেন, ‘শেখ মনিরুল আলমগীর ক্রীড়া পাঠাগার সংগ্রহশালা ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশের প্রথম ক্রীড়া পাঠাগার। একজন ক্রীড়াপ্রেমী হিসেবে তাঁর এই মহতী উদ্যোগকে অভিনন্দন। তিনি একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে এমন সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যে ইচ্ছা থাকলেই সম্ভব। আমি তাঁর পাঠাগারের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।’
পাঠাগার থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখা গেল, নতুন পরিদর্শন বইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের বাসিন্দা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃষ্টি নামের একটি মেয়ে ইংরেজিতে একটি কবিতা লিখে গেছেন। তাঁর প্রথম দুটি চরণ এ রকম—‘টু মি ইট ইজ মোর দ্যান গেম/ আ ব্যাটল অব স্ট্র্যাটেজি, টু উইন অ্যান্ড অ্যাচিভ ফেম।’