টানা চার দিনের ভারী বর্ষণে কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে ভূমিধসের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১০ আশ্রয়শিবিরের ১১৯টি স্থানে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে হাজারো রোহিঙ্গা বসতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভূমিধসের ঝুঁকি থেকে জীবন রক্ষায় রোহিঙ্গাদের সচেতন ও সতর্ক করা হচ্ছে।
গতকাল সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে বালুখালী আশ্রয়শিবিরে পাহাড়ধসে রোহিঙ্গা আনোয়ার ইসলামের ঘর চাপা পড়ে। এতে তাঁর স্ত্রী জান্নাত আরা (২৮) এবং মেয়ে মাহিম আক্তার (২) নিহত হন।
আজ সকালে আশ্রয়শিবিরের পরিস্থিতি দেখতে ঘটনাস্থলে যান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভারী বর্ষণের ফলে আশ্রয়শিবিরের বিভিন্ন পাহাড়ে ফাটল ধরে মাটিধসের ঘটনা ঘটছে। আজ দুপুর পর্যন্ত ৪৬টি বড় ধরনের ভূমিধস ও ৭৩টি মাঝারি ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। ভূমিধসে দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৪৬৫টি রোহিঙ্গা বসতি। পাহাড়ি ঢলের পানিতে উখিয়ার মধুরছড়া, বালুখালী, লম্বাশিয়া খাল ও ছড়া উপচে কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ও জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত ঘরবাড়ির রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনার কাজ চলছে। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে বলে জানান তিনি।
পুলিশ, দমকল বাহিনী ও আরআরআরসি কার্যালয়ের তথ্য মতে, ভারী বর্ষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উখিয়ার বালুখালীর পাঁচটি আশ্রয়শিবির (ক্যাম্প-৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২) এবং মধুরছড়া, লম্বাশিয়া, জুমশিয়া ও কুতুপালং আশ্রয়শিবির। এসব আশ্রয়শিবিরে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা রয়েছেন। এ পর্যন্ত ভূমিধসে ৯টি শিশুশিক্ষা কেন্দ্র, চারটি মসজিদ ও ২০টি শৌচাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জায়গা থেকে ৯০ জন রোহিঙ্গাকে অন্যত্র সরিয়ে আনা হয়েছে।
আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমির জাফর বলেন, টানা চার দিনের ভারী বর্ষণে আশ্রয়শিবিরগুলোর পাহাড়ে ফাটল ধরে মাটি ধসে পড়ার ঘটনা ঘটছে।
উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে একটি পাহাড়ের খাদে ত্রিপলের ছাউনির ছোট্ট ঘরে স্ত্রী ও তিন ছেলে–মেয়ে নিয়ে থাকেন রোহিঙ্গা ছিদ্দিক আহমদ (৪৫)। গতকাল রাতের ভারী বর্ষণে তাঁর ঘরের তলার মাটি অর্ধেক সরে গেছে। আজ মঙ্গলবার সকালে ঘরটি হেলে পড়েছে। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে ঘরটি ধসে পড়তে পারে। এ কারণে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছিদ্দিক আহমদ সমতলের একটি ত্রাণকেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
ছিদ্দিক বলেন, পাহাড়ের চূড়ার ঢালুতে অন্তত দেড় হাজার ঘর তৈরি করা হয়েছে ত্রিপল এবং বাঁশ দিয়ে। ভারী বর্ষণ হলে হাজারো রোহিঙ্গার ঘুম হারাম হয় ভূমি ধসের আতঙ্কে। ছয় বছর হতে চলেছে, মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
দেখা গেছে, উখিয়ার ২৩টি আশ্রয়শিবির গড়ে তোলা হয়েছে ছয় হাজার একরের ২০-২৫টি সরকারি পাহাড় কেটে। এসব আশ্রয়শিবিরে থাকছেন ৯ লাখ রোহিঙ্গা। ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গার ঘর তৈরি হয়েছে পাহাড় চূড়ায় ও তার ঢালুতে। ভারী বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে ঝুপড়িগুলো ভেঙে যাচ্ছে।
লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা আবদুল জলিল (৫৫) বলেন, গত তিন দিনের ভারী বর্ষণে এই আশ্রয়শিবিরের অধিকাংশ পাহাড়ে বড় বড় ফাটল ধরেছে। বৃষ্টির পানি ফাটলে ঢুকে মাটি ধসে পড়ছে। ভূমিধসের শঙ্কায় ইতিমধ্যে এই শিবিরের ৭০-৮০টি পরিবার অন্যত্র সরে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় মোখার সময় উখিয়ার আশ্রয়শিবিরগুলোতে ভূমিধসের ঝুঁকিতে চিহ্নিত ছিল প্রায় ২১ হাজার ঘর। এবারের ভারী বর্ষণে প্রায় ২৫ হাজার ঘরকে ভূমিধসের ঝুঁকির তালিকায় রাখা হয়েছে।