বগুড়ায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। আজ শনিবার বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে চলা সংঘর্ষে অন্তত ছয় শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহত শিক্ষার্থীদের বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ এবং মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী চলা এ সংঘর্ষে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও শটগানের গুলি ছোড়ে। শহরের সাতমাথা, সার্কিট হাউস মোড়, রোমেনা আফাজ সড়ক, কালীবাড়ি মোড়, বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বাকি সড়ক, জেলখানা মোড়সহ শহরের বিভিন্ন স্থান রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক সমন্বয়ক দাবি করেন, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ বিনা উসকানিতে হামলা ও মুহুর্মুহু গুলি চালিয়েছে। গুলি, রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেলের আঘাতে অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থীদের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, আজ সংঘর্ষের ঘটনায় হাসান (২৪) নামের গুলিবিদ্ধ একজনকে এ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর বাড়ি বগুড়ার সাবগ্রাম এলাকায়।
অন্যদিকে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শফিক আমিন কাজল প্রথম আলোকে বলেন, সংঘর্ষে রাবার বুলেটের আঘাতে আহত পাঁচজনকে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের হত্যা, গণগ্রেপ্তার, নির্যাতনের প্রতিবাদে ও সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বেলা আড়াইটা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে হাজারো শিক্ষার্থী-জনতা বগুড়া শহরের সাতমাথা এলাকায় অবস্থান নেন। তাঁরা বৃষ্টিতে ভিজে বিক্ষোভ করতে থাকেন। শিক্ষার্থীদের মিছিল-স্লোগানে সাতমাথা এলাকা পুরোপুরি জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন চলাচল।
সাতমাথার সমাবেশ থেকে ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’, ‘দাবি এক, দফা এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ ইত্যাদি স্লোগান দেওয়া হয়। বেলা তিনটার দিকে সাতমাথা থেকে মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় জিলা স্কুলের ফটকের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন। দীর্ঘ মিছিলটি জিলা স্কুল অতিক্রম করার সময় পুলিশকে দেখে শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দেন। এ সময় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এ সময় মিছিল থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল, বোতল ও জুতা নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জিলা স্কুলের ভেতরে অবস্থান নেন। এ ঘটনার পর পুলিশ মারমুখী হয়।
মিছিলের একাংশ সার্কিট হাউস মোড় অতিক্রম করার সময় পুলিশ প্লাজার সামনে সাঁজোয়া যানে থাকা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে মুহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও গুলি ছোড়ে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা উত্তেজিত হয়ে সার্কিট হাউসের অভ্যর্থনাকক্ষের কাচ ভাঙচুর করেন। পরে জলেশ্বরীতলা, সাতমাথা, সার্কিট হাউস মোড়, জেলা জজ আদালতের সামনের সড়ক, কালীবাড়ি মোড়, বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল বাকি সড়কসহ গোটা শহরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। পরে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ সাতমাথায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ব্যানার-প্যানা ছিঁড়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করেন। এ ছাড়া বিক্ষোভকারীরা সাতমাথায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সে কাগজ ও পুরোনো কাপড় রেখে আগুন ধরিয়ে দেন।
এদিকে আজকের সংঘর্ষে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে মরিচের গুঁড়া ভর্তি ‘চিলি শেল’ ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশের ছোড়া শেলে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ পথচারী ও আশপাশের বাসিন্দাদেরও দীর্ঘক্ষণ ধরে চোখে যন্ত্রণা পোহাতে হয়।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে কাঁদানে গ্যাসের শেলের আদলে তৈরি একধরনের শেল নিক্ষেপ করেছে পুলিশ। মরিচের গুঁড়াভর্তি এই চিলি শেল নিক্ষেপের কারণে হাজারো শিক্ষার্থী চোখে অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করেছেন। এই শেল ছোড়ায় দীর্ঘক্ষণ তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করেন আন্দোলনকারীরা। বিশেষ করে স্কুলের শিশুশিক্ষার্থীদের যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখা যায়।
মিছিলে আসা বগুড়ার একটি সরকারি একটি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এক ছাত্রী বলে, ‘পুলিশ গুলির সঙ্গে মরিচের গুঁড়াভর্তি চিলি শেল ছুড়েছে। এতে আধা ঘণ্টা দুই চোখে তীব্র যন্ত্রণায় কিছুই দেখতে পারিনি।’ আন্দোলনকারীদের একজন সমন্বয়ক বলেন, চিলি শেল নিক্ষেপ করায় হাজারো শিক্ষার্থীকে চোখে তীব্র যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার স্নিগ্ধ আখতার প্রথম আলোকে বলেন, বিক্ষোভকারীরা জিলা স্কুলের সামনে ও পুলিশ প্লাজার সামনে পুলিশকে লক্ষ্য করে বিনা উসকানিতে ইটপাটকেল ছুড়লে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ছাড়া আর অন্য কিছু ছুড়েছে কি না, তা পরে জানানো হবে।