বয়স যখন দুই বছর, তখন টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে দুই পা অবশ হয়ে যায় খালেদা বেগমের (৪২)। এর মধ্যেই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয় তাঁর। খালেদার প্রথম সন্তান জন্মের পাঁচ দিনের মাথায় মারা যায়। এরপর অনেকেই তাঁকে বলতেন ‘অপয়া’। দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর তাঁকে ছেড়ে চলে যান স্বামী। এ অবস্থায় সংসারের হাল ধরতে সেলাইয়ের কাজ শিখে শুরু করেন আয়রোজগার। সঙ্গে চলে হাঁস-মুরগি পালন। এখন প্রতি মাসে খালেদার আয় ২৫-৩০ হাজার টাকা। নিজের আয়রোজগারে ছেলেকেও পড়িয়েছেন স্নাতক পর্যন্ত।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আর অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করে খালেদা কেবল নিজেই স্বাবলম্বী হননি, বদলে দিয়েছেন অনেক নারীর ভাগ্যও। সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলছেন অসহায়, প্রতিবন্ধী ও দুস্থ নারীদের। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের শিলাইগড়া গ্রামের দিঘিরপাড় এলাকার বাসিন্দা খালেদা বেগম।
সম্প্রতি বারখাইন ইউনিয়নের শিলাইগড়া গ্রামে খালেদার ঘরে গিয়ে দেখা যায়, তিন কক্ষের একটি টিনশেড ঘর। ওই ঘরের একটি কক্ষে মা ছেনোয়ারা এবং আরেক কক্ষে ছেলে নেছারুল ইসলামকে নিয়ে থাকেন খালেদা। অপর কক্ষটিতে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নিজের ঘরে সেলাইয়ের কাজ করতে দেখা যায় খালেদাকে। কাজ করার সময় মা ছেনোয়ারা বেগম তাঁকে সাহায্য করছিলেন। ঘরের বাক্সে ভরা আছে বিভিন্ন ধরনের সম্মাননা সনদ।
খালেদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামী চলে যাওয়ার পর ছেলে নেছারুল ইসলামকে নিয়ে শুরু হয় আমার বেঁচে থাকার লড়াই। একপর্যায়ে হতাশায় মুষড়ে পড়ি, বাঁচতেই ইচ্ছা করছিল না। তবে পিছু হটিনি। সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে নেমে পড়ি আয়রোজগারে। সেলাইয়ের পাশাপাশি শুরু করি হাঁস-মুরগি পালনও। আস্তে আস্তে সফলতা ও সচ্ছলতার মুখও দেখতে পাই।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে নেছারুল এখন স্নাতক শেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকে অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। আমিও মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় করি। সব মিলিয়ে আমি নিজেও স্বাবলম্বী। স্বাবলম্বী করতে চাই আরও নারীকে, যাঁদের সমাজ বোঝা মনে করে।’
খালেদা আরও বলেন, ‘আমাকে বেঁচে থাকতে, ঘুরে দাঁড়াতে, সাহায্য করেছিল সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু উন্নয়ন সংস্থা। প্রথমে ২০০৬ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সংশপ্তক থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিই আমি। এরপর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে হাঁস-মুরগি পালন, গবাদিপশু পালন ও সেলাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ২০০৮ সালে সংশপ্তক থেকে একটি সেলাই মেশিন অনুদান পেয়ে কাজে নেমে পড়ি।’
২০০৯ সাল থেকে আনোয়ারা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে খালেদা বেগম সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে ১ম ব্যাচে ৩০ জনকে সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করি। এখন নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। দৈনিক ৩ ঘণ্টা করে সময় দিলেও প্রতিটি ব্যাচ বের হতে এক মাস সময় লাগে। প্রশিক্ষণকালীন সম্মানী দেয় যুব উন্নয়ন। প্রশিক্ষণ শেষে সনদ দেওয়া হয়। কমপক্ষে ৭০০ নারী সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। সবাই নিজে মেশিন কিনে সেলাই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সেলাই প্রশিক্ষণের সনদ নিয়ে অনেক নারী কেইপিজেডের গার্মেন্টসেও চাকরি করছেন। এর বাইরে ব্যক্তিগতভাবে মাসে চারজনকে সেলাই শেখাচ্ছি।’
খালেদা বেগম আরও বলেন, ‘সরকারের সহায়তায় আমি প্রতিবন্ধী ও দরিদ্র নারীকে সেলাই এবং ব্লক-বাটিকের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি নিয়মিত। ২০১৬ সালে জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর আমাকে সফল আত্মকর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর আগে ২০১১ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে সম্মাননাসহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ ২০১৭’-এ চট্টগ্রাম বিভাগে সফল নারী হিসেবে সম্মাননা পেয়েছি।’
স্থানীয় লোকজন জানান, পুরো আনোয়ারা উপজেলার কথা বাদ দিলেও কেবল পাড়াতেই খালেদার কাছে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অন্তত ৩০-৩৫ জন নারী। তাঁরা সংসারের কাজকর্মের ফাঁকে সেলাই কাজ করে সংসারে অর্থের জোগান দিচ্ছেন। পাশের গ্রাম উত্তর শিলাইগড়াতে তিনি ৩ ব্যাচে ৯০ জনকে সেলাই শিখিয়েছেন। প্রশিক্ষণ নেওয়া হালিমা বেগম বলেন, ‘খালেদা আপা জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়ার সময় সেলাই মেশিন নিয়ে নতুন করে শুরু করেন। এরপর আস্তে আস্তে পাল্টে যায় জীবন, হয়ে ওঠেন সফল উদ্যোক্তা। খালেদা আপা আমাদের আদর্শ।’একই কথা বলেন রুবি আখতার, আফরোজা বেগম ও ফারজানা আখতারও।
খালেদার মা ছেনোয়ারা বলেন, ‘শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আটকাতে পারেনি আমার মেয়েকে। সে সফল হয়েছে। আমার মেয়েকে দেখে এখন সাহস পাচ্ছে অনেক নারী।’
আনোয়ারা উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা রেজাউল করিম ভূঁইয়া বলেন, ‘খালেদা আমাদের ভ্রাম্যমাণ প্রশিক্ষক হিসেবে এখন প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সব ধরনের কর্মসূচিতে তাঁর সফল পদচারণ আছে। প্রতিবন্ধকতা জয় করে সফল একজন নারী হিসেবে তিনি সমাজে আলো ছড়াচ্ছেন।’
আনোয়ারার ইউএনও তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পেলে প্রতিবন্ধীরাও যে সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা পালন করতে পারেন, খালেদা এর ভালো উদাহরণ।’