কিশোরগঞ্জের নিকলীর দামপাড়া ইউনিয়নের টেকপাড়া গ্রামের নারীরা তালপাতার হাতপাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত। শুভা রানী সূত্রধরের (বাঁ থেকে প্রথম) কাছ থেকে অন্যরা এই কাজ শিখেছিলেন
কিশোরগঞ্জের নিকলীর দামপাড়া ইউনিয়নের টেকপাড়া গ্রামের নারীরা তালপাতার হাতপাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত। শুভা রানী সূত্রধরের (বাঁ থেকে প্রথম) কাছ থেকে অন্যরা এই কাজ শিখেছিলেন

যেভাবে ‘তালপাখার গ্রাম’, পেছনে বেদনার ইতিহাস

কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চল নিকলীর দামপাড়া ইউনিয়নের দুটি গ্রামের নারীদের তৈরি তালপাতার হাতপাখায় ঘোরে সংসারের চাকা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দুই গ্রামের অন্তত ৩৪ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে শুরু হয় নারীদের সংগ্রাম। সংসারের চাকা ঘোরাতে অনেকে বেছে নেন তালপাতার হাতপাখা বানানোর কাজ।

প্রায় ৫৩ বছর আগে দামপাড়া ইউনিয়নের টেকপাড়া গ্রামের শুভা রানী সূত্রধর শুরু করেন তালপাতার হাতপাখা তৈরির কাজ। তিনি তাঁর বাবার বাড়ি থেকে শিখে আসা সেই পাখা তৈরির কাজ শেখান অন্য নারীদেরও। এর পর থেকে আস্তে আস্তে টেকপাড়া ও বর্মণপাড়া গ্রামের বেশির ভাগ নারী জড়ান এই কাজে।

শুভার বয়স এখন ৮৫ বছর। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও তিনি প্রতিদিন যত্ন নিয়ে তৈরি করেন তালপাতার হাতপাখা। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর স্বামী কার্তিক সূত্রধরকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। পাশের গ্রামের অনেক পুরুষকেও হত্যা করা হয়। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে নারীরা হাতপাখা বানানোর কাজ শুরু করেন।

৫০ বছরের বেশি সময় ধরে পাখা তৈরির খ্যাতির কারণে অনেকেই গ্রাম দুটিকে ‘তালপাখার গ্রাম’ বলে চেনেন। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের লোকজন তালপাতার হাতপাখা তৈরির কাজে যুক্ত। এখানকার কেউ পাখার কারিগর, আবার কেউ ব্যবসায়ী। সারা বছর অন্য কাজ করলেও চৈত্র মাস আসার আগে থেকে গ্রামের দৃশ্যপট বদলে যায়। ঘর ও উঠানে বসে হাতপাখার কাজে ব্যস্ত থাকেন প্রায় সবাই।

সম্প্রতি এই দুই গ্রামে সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় সব বাড়ির ঘরের আঙিনায় বসে হাতপাখা তৈরির ব্যস্ততা চলছে। কল্পনা রানী ও তাঁর স্কুলপড়ুয়া মেয়ে পূর্ণিমা রানী মিলে তৈরি করছেন তালপাখার হাতপাখা। এ সময় দেখা যায়, কেউ তালপাতা চিরিয়ে নিচ্ছেন, কেউ হাতপাখা তৈরি করছেন, কেউ তৈরি করা হাতপাখায় বেত দিয়ে চাকা বাঁধছেন, আবার কেউ তালপাতায় রং মাখাচ্ছেন। একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত। কিছু কিছু পরিবারের পুরুষেরা বাঁশ কেটে তাঁদের কাজে সহযোগিতা করছেন।

গ্রামের বেশির ভাগ নারী হাতপাখা বানানোর কাজ করেন

অর্চনা নামের একজন বলেন, কয়েকজনের শ্রমে তৈরি হয় একটি হাতপাখা। পাখা তৈরির মূল উপকরণ তালপাতা, বেত, বাঁশ, প্লাস্টিক ও রং। প্রথমে তিন-চার ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে অথবা রোদে রাখা হয় তালপাতা। এরপর সেই পাতা সুবিধামতো আকারে কাটা হয়। এরপর সরু লম্বা কাঠি দিয়ে বেঁধে ও রং করে পাখা তৈরি করা হয়। মানভেদে একটি হাতপাখা ৭০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়।

তবে উপকরণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় এই দামে পাখা বিক্রি করে পোষায় না বলে জানালেন কল্পনা নামের একজন। তিনি বলেন, এখন তালপাতা, বেত, বাঁশসহ হাতপাখা তৈরির সব উপকরণের দাম বাড়ায় খরচ বেশি হয়। যে তালপাতা ছিল ১০ টাকা, এখন সেটা প্রায় ৫০ টাকা। ১০০ টাকার বাঁশ হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। সে তুলনায় দাম পাওয়া যায় না।

টেকপাড়ার সজীব সূত্রধর বলেন, নারীরাই মূলত হাতপাখা তৈরি করেন। পুরুষেরা বাজার থেকে বাঁশ কেনাসহ অন্যান্য জিনিস কেনাকাটায় সহযোগিতা করে থাকেন। সবকিছুর যেভাবে দাম বাড়ছে, সরকার তাদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে তাদের উপকার হতো।

এ বিষয়ে নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পাপিয়া আক্তার বলেন, হাওরাঞ্চলের সংগ্রামী নারীদের হাতে তৈরি তালপাখার এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করা হবে। খোঁজখবর নিয়ে তাঁদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।