নদীদূষণ পরিস্থিতি দেখে হতাশ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান

বিসিক চামড়া শিল্প নগর ও ধলেশ্বরী নদী দূষণ পরিদর্শন শেষে সভায় যোগ দেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী। আজ সোমবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

নদীদূষণ পরিস্থিতি দেখতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী আজ সোমবার সাভারের হেমায়েতপুরে বিসিক চামড়াশিল্প নগর পরিদর্শনে গিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘চামড়াশিল্প নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক কার্যক্রম নিয়ে আমরা হতাশ। ল্যাবে এসে দেখি, ল্যাবের ইনচার্জ অনুপস্থিত। তাঁর অবর্তমানে কোনো লোক নেই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। এটি দুর্ভাগ্যজনক। ট্যানারিগুলো লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সদস্য হলে চামড়াশিল্প কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে। কিন্তু সে বিষয়ে তাদের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ল না। প্রতিদিন কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারে তরল বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার হলেও ট্যানারিমালিকেরা এর চেয়ে বেশি বর্জ্য উৎপাদন করছেন। আমরা শুনেছি, বিসিক আরও দুটি চামড়াশিল্প প্রতিষ্ঠান করতে যাচ্ছে। সেটিকে আমরা নেতিবাচক বলব। এটি তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, সাভারের এই চামড়াশিল্প নগরকেই তারা লেজেগোবরে করে ফেলেছে।’

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরের বর্জ্যে ধলেশ্বরী নদীর পানিসহ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে প্রায়ই এমন অভিযোগ উঠছে। ধলেশ্বরীর সঙ্গে বংশী, বুড়িগঙ্গাসহ বিভিন্ন নদীর সংযোগ রয়েছে। এ কারণে ওই সব নদীর দূষণের বিষয়টিও উঠে আসছে। দূষণের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) পক্ষ থেকে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেগুলো নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সরেজমিনে দেখে আমরা আশ্বস্ত হতে পারিনি। আমরা কোনোভাবেই কারখানা বন্ধ রাখার পক্ষে নই। তবে অবস্থার উন্নতি না হলে বর্তমানে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করা হবে।’

সাভারের চামড়াশিল্প নগরের প্রধান ফটক

সকালে চামড়াশিল্প নগরে ধলেশ্বরী নদীর দূষণ রোধে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী। পরে তিনি অ্যাপেক্স ট্যানারি ঘুরে দেখেন। এরপর তিনি ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেড নিয়ন্ত্রিত সিইটিপি পরিদর্শন করেন। তিনি সিইটিপির ল্যাব পরিদর্শনকালে ল্যাব টেকনিশিয়ান অনুপস্থিত ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি না থাকায় হতাশা ব্যক্ত করেন। পরে সিইটিপি–সংলগ্ন ধলেশ্বরী নদীর পানিদূষণের বিষয়টি দেখতে যান তিনি।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘নদীর তীরে যে বা যারাই ময়লা ফেলুক না কেন, এক মাস পরে পুনরায় পরিদর্শনকালে এ অবস্থা আর দেখতে চাই না।’

এ সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সাভারের ভূগর্ভস্থ পানির দূষণের কথা বলা হচ্ছে। সেখানেও নাকি ইনজেক্ট করে তরল বর্জ্য ভূগর্ভে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এসব কারণে সাভার একটি অভিশপ্ত জনপদে পরিণত হতে যাচ্ছে, যা কখনো কাম্য নয়। সবচেয়ে ভালো যে ট্যানারি, সেটি দেখানো হয়েছে। তবে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তারা কী পরিমাণ চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে, সেটির স্বচ্ছতার বিষয়ে সন্তুষ্ট হতে পারিনি।’
‘এ অবস্থা আর দেখতে চাই না’

বেলা পৌনে একটার দিকে মনজুর আহমেদ চৌধুরী উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির মতবিনিময় সভায় যোগ দেন। সাভার উপজেলা পরিষদের সম্মেলনকক্ষে উপজেলা প্রশাসন এই সভার আয়োজন করে।

সভায় সাভার পৌরসভার মেয়র, সাভার উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, সাভার নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদ, সাভার উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, সাভারের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারাসহ স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা অংশ নেন।

সাভারের হেমায়েতপুরের বিভিন্ন কারখানার তরল বর্জ্য এভাবে সরাসরি এসে মিশছে ধলেশ্বরী নদীতে

পৌর মেয়র হাজী মো. আবদুল গণি বলেন, নদী ও খাল দখল রোধে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে পিলার স্থাপন করতে হবে। তিনি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব ডাম্পিং ইয়ার্ড না থাকায় সাভারের বিভিন্ন এলাকার কঠিন বর্জ্য ফেলার ক্ষেত্রে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে বলে জানান।

সাভারের নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম মোল্লা বলেন, নদী ও খাল দখলের অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে, তাঁরা প্রায় সবাই ক্ষমতাবান। তাঁদের তালিকা তৈরি করতে হবে। তালিকা ধরে ধরে দখলমুক্ত করার কাজ শুরু করতে হবে।

পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, নদীদূষণ ও রক্ষার বিষয়ে আইন আছে, নীতি আছে, কিন্তু তবু কোনো কাজ হচ্ছে না। মাটির উপরিভাগে দূষণের পাশাপাশি তরল বর্জ্য ইনজেক্ট করে ভূগর্ভে পাঠিয়ে দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানিও দূষিত করা হচ্ছে। সাভারের নদী দখলদারদের তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশের দাবি জানান তিনি।
পরে কমিশনের পক্ষ থেকে সাভারে বংশী নদীর পাড়ে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ফেলার ভিডিও প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয়। ওই ভিডিওতে বর্জ্যবাহী ভ্যানগাড়ির চালকেরা পৌরসভার নির্দেশে এসব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে বলে দাবি করেন। তবে মেয়র বিষয়টি অস্বীকার করেন। ওই বর্জ্য পৌরসভার পক্ষ থেকে ফেলা হচ্ছে না দাবি করেন তিনি।

আলোচনার সার্বিক বিষয়ে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘দখলদারদের তালিকা তৈরিতে স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মাধ্যমের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সহযোগিতা নেওয়া হয়। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নদীর তীরে যে বা যারাই ময়লা ফেলুক না কেন, এক মাস পরে পুনরায় পরিদর্শনকালে এ অবস্থা আর দেখতে চাই না।’ তিনি বলেন, সাভারের আমিনবাজারের বর্জ্য ডাম্পিং স্টেশনে ঢাকার সব ময়লা ফেলা হচ্ছে। কিন্তু সাভারের ময়লা ফেলার জায়গা নেই, এটি হতে পারে না। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করে শুধু ফাইল চালাচালি নয়, দাবি আদায়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।

পরে তিনি সাভার উপজেলার ১৮৩টি স্থানে বর্জ্য ফেলার তালিকা পৌর মেয়রের কাছে হস্তান্তর করে দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বলেন।

চামড়া শুকানোর কাজে ব্যস্ত এক শ্রমিক

পরিদর্শনকালে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক (স্বাস্থ্য) মো. মতিউর রহমান, নৌ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সোলায়মান মিয়া, সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাজহারুল ইসলাম, বিসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উপপরিচালক মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার, খ ম কবিরুল ইসলাম, উপপ্রধান এ এম মহিউদ্দিন কবীর মাহিন, পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জহিরুল ইসলাম তালুকদার, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) কোষাধ্যক্ষ এস এম আওলাদ হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।