পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর অস্ত্রোপচার করছেন পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন মোস্তফা জামান চৌধুরীসহ অন্য চিকিৎসকেরা। ১৭ এপ্রিল দুপুরে
পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর অস্ত্রোপচার করছেন পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন মোস্তফা জামান চৌধুরীসহ অন্য চিকিৎসকেরা। ১৭ এপ্রিল দুপুরে

বন্ধ ওটিতে প্রাণের সঞ্চার

সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে অস্ত্রোপচার করছেন চিকিৎসকেরা। আট মাসে চারটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩১২টি অস্ত্রোপচার।

কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অস্ত্রোপচারকক্ষ (ওটি) ৫ বছর ধরে তালাবদ্ধ। কোনোটি ৯ বছর। কোনোটিতে আবার অস্ত্রোপচারকক্ষ কখনো খোলা হয়নি। পঞ্চগড় জেলার এই চিত্র ৯ মাস আগের।

আগের মতো নানা সংকট এখনো আছে। তবে প্রতিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রুটিন মেনে অস্ত্রোপচার হচ্ছে। এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিভিল সার্জন মোস্তফা জামান চৌধুরী। তাঁকে সহায়তা করছেন সদর হাসপাতালের একদল চিকিৎসক। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষেরা এই সেবা নিচ্ছেন প্রায় বিনা মূল্যে।

আটোয়ারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৭ এপ্রিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ছেলেসন্তানের জন্ম দেন দিঘিপাড়া গ্রামের মেয়ে মুক্তি রানী। তাঁর স্বামী পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া ইউনিয়নের উত্তর কুচিপাড়ার বাসিন্দা বোধন চন্দ্র পেশায় ভ্যানচালক। বোধনের বোন বৃষ্টি রায় প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসকেরা আগেই জানিয়েছিলেন মুক্তির সিজার করাতে হবে। টাকা জোগাড় করতে বোধন চন্দ্র ভ্যান বেচতে চেয়েছিলেন। পরে জানতে পারেন এখানে প্রতি বুধবার বিনা পয়সায় সিজার করা হয়। বৃষ্টি রায় বলেন, ‘পরে আমরা (মুক্তিকে) এখানে নিয়ে আসি। সিজারে একটা ছেলে হয়েছে। ওষুধও দিয়েছে কিছু। এখানে সিজার করাতে না পারলে আমার ভাইটাকে ভ্যানটা বিক্রি করে দিতে হতো। অনেক বড় উপকার হলো আমার ভাইটার।’

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাব বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত (১৭ এপ্রিল) জেলার চারটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মুক্তি রায়ের মতো ২০৬ জন নারী অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। অন্যান্য ধরনের ছোটখাটো অস্ত্রোপচার হয়েছে ১০৬টি। শেষ আট মাসে জেলার চারটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট ৩১২টি অস্ত্রোপচার হয়েছে।

পরে আমরা (মুক্তিকে) এখানে নিয়ে আসি। সিজারে একটা ছেলে হয়েছে। ওষুধও দিয়েছে কিছু। এখানে সিজার করাতে না পারলে আমার ভাইটাকে ভ্যানটা বিক্রি করে দিতে হতো। অনেক বড় উপকার হলো আমার ভাইটার
বৃষ্টি রায়

একজনের ডাকে সাড়া দিলেন অন্যরা

২০২৩ সালের ১৩ জুলাই পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জনের দায়িত্ব নেন নিউরোসার্জারির চিকিৎসক মোস্তফা জামান চৌধুরী। জেলায় এসে তিনি জানতে পারেন, আটোয়ারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে অস্ত্রোপচারকক্ষ উদ্বোধন করা হয়। পরদিনই অবেদনবিদ বদলি হওয়ায় সেখানে কোনো অস্ত্রোপচার হয়নি। দেবীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২ বছর, বোদায় ৫ বছর ও তেঁতুলিয়ায় ৯ বছর ধরে অস্ত্রোপচার বন্ধ। এই চিত্র নিয়ে প্রথম আলোতে একাধিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।

এমন অবস্থায় পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের অবেদনবিদসহ অন্য চিকিৎসকদের নিয়ে বসেন সিভিল সার্জন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে অস্ত্রোপচার চালুর বিষয়ে মতামত জানতে চান। সবাই ইতিবাচক সাড়া দেন। গত আগস্টের মাঝামাঝি দেবীগঞ্জে প্রথম অস্ত্রোপচার চালু করা হয়। একে একে আলো জ্বলে বোদা, আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অস্ত্রোপচারকক্ষেও। 

সিভিল সার্জন বলেন, শুরুতে দেখা যায় কোথাও চিকিৎসকসংকট, কোথাও জনবলসংকট আর কোথাও সরঞ্জামসংকট। অনেক জায়গায় যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দী। পরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর অনেক নার্সকে সদর হাসপাতালের ওটিতে এনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো চিকিৎসকসংকট। প্রথম দিকে দক্ষ জনবলের অভাবে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। তবে সব চিকিৎসক সহায়তা করেন। এখন সবার আন্তরিকতা আর দক্ষতায় অস্ত্রোপচার চলছে। 

প্রতি শনি, রবি ও সোমবার বোদায়, সোমবার দেবীগঞ্জে, মঙ্গলবার তেঁতুলিয়া ও বুধবার আটোয়ারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়মিত অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। সিভিল সার্জন, একজন অবেদনবিদসহ পঞ্চগড় থেকে চারজন চিকিৎসকের দল প্রতিটি উপজেলায় ঘুরে এসব অস্ত্রোপচার করছেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে কর্মরত চিকিৎসকেরা তাঁদের সহায়তা করেন।

দেবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান বলেন, প্রায় দুই বছর ধরে চিকিৎসকসংকটে অস্ত্রোপচারকক্ষটি বন্ধ ছিল। সিভিল সার্জনের প্রচেষ্টায় এখানে নতুন করে অস্ত্রোপচার শুরু হয়েছে। এতে এই এলাকার সাধারণ মানুষ অনেক উপকৃত হচ্ছেন।

মোস্তফা জামান চৌধুরী ২০১৭ সালের পর রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ছিলেন। ২০২০ সালে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে যোগ দেন। তারাগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী সাগর কুমার মহন্ত প্রথম আলোকে বলেন, মোস্তফা জামান চৌধুরী কর্মরত থাকাকালে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেতরে ও সামনে ফুলের বাগান করেন। করোনাকালে মানুষকে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে নানা সচেতনতামূলক কাজ করেছেন।

ছুটে চলেন চিকিৎসকেরা

সিভিল সার্জনের কার্যালয়, সদর হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মিলিয়ে জেলায় চিকিৎসকের পদ আছে ১৩৫টি। এর মধ্যে চিকিৎসক আছেন মাত্র ৫০ জন। বাকি ৮৫টি পদই (৬৩ শতাংশ) শূন্য। চিকিৎসকেরা বলছেন, সংকটের মধ্যেই নিয়মিত অস্ত্রোপচার হচ্ছে। সিভিল সার্জন নিজে গিয়ে অস্ত্রোপচার করেন। তাঁর সঙ্গে থাকেন সদর হাসপাতালের অবেদনবিদ (কনসালট্যান্ট অ্যানেসথেসিয়া) মনসুর আলম ও সিরাজউদ্দৌলা পলিন, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি অ্যান্ড অব্‌স) আফিফা জিন্নাতসহ অন্য চিকিৎসকেরা। 

এ জন্য প্রতিদিন খুব সকালে ছুটতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। অস্ত্রোপচার শেষ করে আবার দাপ্তরিক কাজ করতে হয়। গাইনি চিকিৎসক আফিফা জিন্নাত বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুই দিন এবং তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চার দিন যান। চিকিৎসকসংকট থাকলে অন্য উপজেলাগুলোতেও যেতে হয়। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকসংকটে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমরা অনেক কিছুই করতে পারছি না। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সিভিল সার্জন স্যারের আন্তরিকতায়, প্রচেষ্টায় এবং তাঁর উদ্যমের কারণে আমরাও আন্তরিকভাবে কাজটা করার চেষ্টা করছি।’ প্রান্তিক মানুষের সেবার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত আফিফা আরও বলেন, অস্ত্রোপচারের সময় একটি যন্ত্রের সংকট থাকলে সদর হাসপাতাল থেকে সিভিল সার্জনের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। অবেদনবিদ না থাকলে নিজের গাড়িতে করে অবেদনবিদ নিয়ে যান সিভিল সার্জন।

সিভিল সার্জন মোস্তফা জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় দেখা গেছে, সকাল সাড়ে সাতটায় উপজেলায় গিয়ে অস্ত্রোপচার করেছেন। পরে আবার এসে দাপ্তরিক কাজে অংশ নিয়েছেন। জটিল কিছু অস্ত্রোপচার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করানো সম্ভব না হলে তাঁদের সদর হাসপাতালের ওটিতে নিয়ে অস্ত্রোপচার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এসব কাজে মানুষ উপকৃত হচ্ছেন, বিশেষ করে প্রান্তিক এলাকার গরিব মানুষ বাড়ির পাশে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া।’

খরচ নেই, ভোগান্তিও কমেছে মানুষের

তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত মঙ্গলবার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেন গৃহবধূ হিমু আক্তার (১৯)। তাঁর বাড়ি বাংলাবান্ধা ইউনিয়নের ঝারুয়া পাড়ায়। স্বামী হাসিবুল ইসলাম বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের শ্রমিক। প্রথমবার মা হওয়া হিমু আক্তার মুঠোফোনে বললেন, এখানে অস্ত্রোপচার করতে না পারলে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে পঞ্চগড়ে গিয়ে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তি হতে হতো। অনেক টাকা লাগত। এখানে প্রায় সবকিছুই বিনা মূল্যে পেয়েছেন। এতে তাঁরা অনেক খুশি।

১৭ এপ্রিল দুপুরে আটোয়ারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, অস্ত্রোপচারকক্ষের বাইরে পায়চারি করছেন রত্না বেগম (৪০)। চোখ-মুখ দেখে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হলো তাঁকে। কাছে গিয়ে কথা বলতেই রত্না জানালেন, স্বামীর মৃত্যুর পর দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট চায়ের দোকানদার বাবার কাছেই থাকেন তিনি। ৭৫ বছর বয়সী বাবা সিজু মোহাম্মদের হার্নিয়া অপারেশন চলছে। টাকাপয়সা না থাকায় স্থানীয়দের ও চিকিৎসকদের পরামর্শে এখানে এসেছেন।

রত্না বেগমের পাশাপাশি আরও কয়েকজন রোগীর স্বজনকে সেখানে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। এদিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আটটি অস্ত্রোপচার করেন সিভিল সার্জনসহ অন্য চিকিৎসকেরা।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, ভারত সীমান্তঘেঁষা এই উপজেলার বেশির ভাগ মানুষই গরিব। এখানে অস্ত্রোপচার করাতে না পেরে অনেক রোগীকেই বেশি টাকা খরচ করে পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও গিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করাতে হতো। সিভিল সার্জনের উদ্যোগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এখানে ওটি চালু করতে পেরেছেন। এতে সাধারণ মানুষ বেশ উপকৃত হচ্ছেন। 

চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ছোটখাটো অস্ত্রোপচারে একজন রোগীর ১৮ হাজার থেকে ২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাগে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসব অস্ত্রোপচার সুবিধা বিনা মূল্যে পাওয়ায় খুশি স্থানীয় রোগীরা।

পঞ্চগড় নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী এরশাদ হোসেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, সিভিল সার্জনের এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এতে একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাড়ির কাছে তাদের কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে। তাঁরা চান এই কার্যক্রম যাতে অব্যাহত থাকে।