মৌলভীবাজারের বড়লেখার হাকালুকি হাওরপারের মাইজমজুড়িতে শর্ষেখেতের যত্ন নিচ্ছেন এক কৃষক। গত মঙ্গলবার
মৌলভীবাজারের বড়লেখার হাকালুকি হাওরপারের মাইজমজুড়িতে শর্ষেখেতের যত্ন নিচ্ছেন এক কৃষক। গত মঙ্গলবার

হাকালুকি হাওরপারে হলুদ জোয়ার

গত বছর বড়লেখা উপজেলায় শর্ষের আবাদ হয়েছিল ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে। এবার হয়েছে ২ হাজার ৫৪০ হেক্টরে।

মৌলভীবাজারের বড়লেখায় হাকালুকি হাওরপারের কৃষকদের কাছে কয়েক বছর ধরে শর্ষের আবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রতিবছরই আবাদ বাড়ছে। গতবারের তুলনায় চলতি বছর প্রায় ৯০০ হেক্টর বেশি জমিতে শর্ষের আবাদ হয়েছে। হাওরপারে যত দূর চোখ যায়, সেদিকেই হলুদ ফুলের সম্ভার।

বড়লেখা উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, হাকালুকি হাওরপারে বারি সরিষা-১৪, ১৭ ও ১৮ এবং বিনা সরিষা-৯ ও ১১ জাতের চাষ হয়েছে। গত বছর বড়লেখা উপজেলায় শর্ষের আবাদ হয়েছিল ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমিতে। এবার হয়েছে ২ হাজার ৫৪০ হেক্টরে। এর মধ্যে বিনা চাষে আবাদ হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে। এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৮৮০ হেক্টর। ফসল তোলা পর্যন্ত প্রতি কিয়ারে (প্রতি কিয়ার=৩০ শতাংশ) ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। ফসল উৎপাদিত হবে কিয়ারে ৪ থেকে ৫ মণ। প্রতিমণ শর্ষের দাম চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা।

হাওরের পানি নেমে যাওয়ার পর এসব জমি পতিত থাকত। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে শর্ষের আবাদে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিনা মূল্যে বীজ ও সার দেওয়া হচ্ছে।
মো. মনোয়ার হোসেন, কৃষি কর্মকর্তা

বড়লেখার হাওরপারের দাসেরবাজার, তালিমপুর, সুজানগর, বর্নি ইউনিয়নের বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, শর্ষের হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে বিভিন্ন মাঠ। দাসেরবাজার ইউনিয়নের মাইজমজুড়ি গ্রামের শর্ষের খেতে অনেকে ছবি তুলছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাইজমজুড়ির প্রায় ২০০ কৃষক শর্ষের চাষ করেছেন।

গ্রামের অরুণ বিশ্বাস গত মঙ্গলবার বলেন, ‘আমরা আগে থাকিই শর্ষের করি। আগে দেশাল (স্থানীয় জাতের) বীজ দিয়া চাষ করতাম। এখন সরকার থাকি (কৃষি বিভাগ) ভালা বীজ দেওয়া অয় (হয়)। প্রায় সব পরিবারই পাঁচ-সাত কিয়ার (বিঘা) খেত করে। তিন-চার বছর ধরি (ধরে) একজনের দেখাদেখি অন্যজন শুরু করছে।’ এবার তিনি সাড়ে তিন কিয়ার জমিতে শর্ষের চাষ করেছেন।

বাবুলাল বিশ্বাস বলেন, আগে এই জমি পতিত থাকত। এখন শর্ষের চাষ করেন। তাঁরা ২৫ কিয়ার জমিতে শর্ষের আবাদ করেছেন। তাঁর ২০-২৫ জনের পরিবার। তেল কিনে খাওয়া লাগে না। গতবারের তেল এখনো আছে। তিনি বলেন, ‘শর্ষের খেত করায় জমিও পতিত থাকে না, মাইনষের (মানুষের) বাড়তি আয়ও অর (হচ্ছে)। খুব সুন্দর হইরো (সরিষা) অইছে (হয়েছে)। কত মানুষ দেখতে আইরা (আসছে), ছবি তুলরা (তুলছেন)।’

আবদুল খালিক বলেন, ‘তেরাকুড়িতে ৭০ থেকে ৮০ জন কৃষক সরিষা করেছেন। কিয়ারে চাইর (চার) থাকি পাঁচ মণ সরিষা আশা কররাম (করছি)। বেচতেও সমস্যা অয় না। ব্যবসায়ীরা ঘর থাকি আইয়া লইয়া (এসে নিয়ে) যায়।’

দাসেরবাজার ইউনিয়নের অহিরকুঞ্জির এমদাদুর রহমান এবারই প্রথম ১০ কিয়ার জমিতে শর্ষে চাষ করেছেন। তিনি বলেন, আমন ধান কাটার পর এই জমি খালি থাকত। ফসল ভালো হয়েছে। খরচ কম, কষ্টও কম।

তালিমপুর ইউনিয়নের দ্বিতীয়ারদেহী গ্রামের পৃথিশ রঞ্জন দাস জানান, বোনা আমন ধান কাটার পর নাড়া পুড়িয়ে সেই জমিতে বিনা চাষে শর্ষের বীজ ছিটিয়ে দেন তাঁরা। তবে রোপা আমনের খেতে হাল চাষ দিতে হয়। প্রতি কিয়ারে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রতি কিয়ারে সাড়ে চার মণ থেকে পাঁচ মণ ফসল আশা করছেন তিনি। তিনি পাঁচ কিয়ার জমিতে শর্ষের চাষ করেছেন। হাকালুকি হাওরের কাজীরবন্দ, মুর্শিবাদকুড়া, দ্বিতীয়ারদেহী, বড় ময়দান এলাকাতেই বেশি শর্ষের চাষ হয়েছে।

বড়লেখা উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পতিত জমির ব্যবহার, উৎপাদন খরচ কম, লাভজনক ও স্বল্পমেয়াদি ফসল হওয়ার কারণে হাকালুকি হাওরপারের কৃষকেরা শর্ষের চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। হাওরপারের তালিমপুর ইউনিয়নের মুর্শিবাদকুড়া, হাল্লা, খুটাউড়া, গগড়া; সুজানগর ইউনিয়নের তেরাকুড়ি, বাগমারা, বারোহালি; দাসেরবাজার ইউনিয়নে মাইজমজুড়ি, দ্বিতীয়ারদেহী, ধর্মদেহী, মালিচিরি এবং বর্নি ইউনিয়নের কাজিরবন্দ ও ছালিয়া এলাকায় শর্ষের চাষ হচ্ছে। এবার নতুন করে চাষের আওতা বেড়েছে খুটাউড়া, গগড়া, রতুলি, বড়খলা, দ্বিতীয়ারদেহী, বোবারতল, অহিরকুঞ্জি এলাকায়।

বড়লেখা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, হাওরের পানি নেমে যাওয়ার পর এসব জমি পতিত থাকত। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে শর্ষের আবাদে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিনা মূল্যে বীজ ও সার দেওয়া হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক কৃষিবিদ সামছুদ্দিন আহমেদ গতকাল বুধবার বলেন, এবার সারা জেলায় শর্ষে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ হাজার ৩০৫ হেক্টর। চাষাবাদ হয়েছে ৫ হাজার ২৫০ হেক্টরে। বীজ বোনার সময় বৃষ্টি হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। তবে বড়লেখায় হাকালুকি হাওরের দিকে আবাদ বেড়েছে।