আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টা। কক্সবাজারের টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ডেইলপাড়ার একটি দোকানে বসে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছিলেন স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা। এ সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে দোকান। বিস্ফোরণের শব্দে কিছুটা ছেদ পড়লেও বাসিন্দারা আলাপ চালিয়ে নিচ্ছিলেন। তিন মিনিটের মাথায় আবারও বিস্ফোরণ ঘটে। কিছুটা বিরক্ত হয়ে আলাপরতদের একজন বলে ওঠেন, মিয়ানমারের মর্টার শেলের বিস্ফোরণে শান্তিতে ঘরে থাকা যাচ্ছে না। ঘরের মাটির দেয়াল ও সীমানাপ্রাচীরে ফাটল ধরেছে। রাতেও শান্তি নেই, দিনের চেয়ে বিস্ফোরণ রাতে আরও বেশি।
ডেইলপাড়া থেকে নাফ নদীর সীমান্ত অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে—পূর্ব দিকে। সেখান থেকে আরও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদী পেরিয়ে ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপ। টানা তিন মাস ধরে সেখানে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত-লড়াই চলছে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ)। এতে প্রতিদিন আতঙ্কে দিন কাটছে টেকনাফের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের।
ডেইলপাড়ার দোকানটিতে যাঁরা ভোট নিয়ে আলাপে মেতে ছিলেন, তাঁদের একজন স্থানীয় পানচাষি আমির হোসেন (৬৮)। তিনি বলেন, নাফ নদীর তীরের গ্রামগুলোয় ওপারের বিস্ফোরণ আরও তীব্রভাবে শোনা যায়।
ডেইলপাড়া থেকে নাফ নদীর সীমান্ত পর্যন্ত রয়েছে টেকনাফ পৌরসভা এলাকার আরও চারটি গ্রাম—চকবাজার, শীলবুনিয়াপাড়া, খাঙ্কারডেইল ও জালিয়াপাড়া। চার গ্রামে ঘরবাড়ি রয়েছেন অন্তত দেড় হাজার।
নাফ নদীর সীমানাঘেঁষা এলাকা দক্ষিণ জালিয়াপাড়া। গ্রামের পূর্ব পাশের বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপ খালি চোখে দেখা যায়। মর্টার শেলের বিস্ফোরণে যখন ওপারের ঘরবাড়ি কিংবা নানা স্থাপনায় আগুন ধরে যাচ্ছে, তা এপার থেকে দেখতে পাচ্ছেন জালিয়াপাড়ার বাসিন্দারা। জালিয়াপাড়ার জেলে সাব্বির আহমদ ও নাজির হোসেন বলেন, টানা তিন মাস ধরে গ্রামের মানুষ বিস্ফোরণের আতঙ্কে রয়েছেন। গুলি এসে পড়ার শঙ্কায় পাড়ার কোনো জেলে নাফ নদীতে মাছ ধরতে নামতে পারছেন না। ঘরে ঘরে অভাব দেখা দিয়েছে।
ডেইলপাড়া থেকে জালিয়াপড়া পর্যন্ত পাঁচটি গ্রামের বাইরেও সীমান্ত এলাকার আরও অন্তত ২৩টি গ্রামের ২০ হাজার মানুষ বিস্ফোরণে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে টেকনাফ সদরের ইউনিয়নের নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাইটংপাড়া, দমদমিয়া, সাবরাং ইউনিয়নের নয়াপাড়া, আছারবুনিয়া, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, বাজারপাড়া, হ্নীলা ইউনিয়নের ফুলের ডেইল, বাজারপাড়া, চৌধুরীপাড়া, খারাংখালী হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পালংখালী, রহমতের বিল, বালুখালী এলাকা।
টেকনাফের বাসিন্দারা জানান, আট দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল সোমবার রাত আটটা থেকে রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের আশপাশের কয়েকটি গ্রামে বিমান হামলা চালাচ্ছে সরকারি বাহিনী। থেমে থেমে তা আজ বিকেল চারটা পর্যন্ত তা স্থায়ী হয়। এরপর সোমবার রাত এবং আজ সকালে দুই দফায় কয়েকটি স্থানে আগুনের কুণ্ডলী আকাশে ভাসতে দেখা গেছে।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, আজ বেলা ১১টার দিকে মংডুর টাউনশিপের পাশে সুধাপাড়া, মগনিপাড়া, নলবনিয়া ও ফাদংছা এলাকায় ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী। যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হয় অসংখ্য মর্টার শেল ও গ্রেনেড-বোমা। তাতে লোকজনের ঘরবাড়ি ও নানা স্থাপনায় আগুন ধরে যায়। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এপার থেকেও তা দেখা গেছে।
টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, আজ বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টায় আকাশ থেকে কয়েক শ মর্টার শেল-গ্রেনেড বোমা ছোড়া হয়েছে। বিস্ফোরণের শব্দে টেকনাফ সীমান্তের মানুষও আতঙ্কে রয়েছেন।
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, ৮-১০ দিন আগে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যে বিজিপির (বর্ডার গার্ড পুলিশ) বেশ কিছু সীমান্তচৌকি দখলে নিয়েছিল। সম্ভবত সেসব চৌকি পুনরুদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে সরকারি বাহিনী। আরাকান আর্মির অবস্থানে মর্টার শেল গ্রেনেড বোমা নিক্ষেপ করছে। তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে।
মিয়ানমারে সংঘাতের মধ্যে ৩ মে থেকে কয়েক দফায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন বিজিপির ১৩৩ সদস্য। সবাইকে নিরস্ত্র করে বিজিবির হেফাজতে রাখা হয়েছে। এর আগে কয়েক দফায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেন মিয়ানমারের আরও ৬১৮ জন। তাঁদের কয়েক ধাপে জাহাজে করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়।
টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, রাখাইনের সংঘাত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও স্থল সীমান্তে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। সীমান্তে টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আদনান চৌধুরী বলেন, বিকট শব্দের বিস্ফোরণে টেকনাফ সীমান্তে মানুষ চরম আতঙ্কে রয়েছেন। লোকজনকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।