গোলগাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন এক দম্পতি। গত শনিবার পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নবীপুর গ্রামে
গোলগাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন এক দম্পতি। গত শনিবার পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নবীপুর গ্রামে

গোলগাছের রসে অনন্য স্বাদের গুড়

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ৩০০ পরিবার গোলগাছের রস দিয়ে গুড় তৈরি করে। এই গুড়ের অনেক পুষ্টি ও ঔষধি গুণ আছে।

চারদিকে ঘন কুয়াশা। কনকনে ঠান্ডা পড়ছে। মেঠো পথ শিশিরভেজা। সেই মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন অমিত মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী নমিতা মণ্ডল। তাঁদের হাতে রশি ও মাটির কলস। যাচ্ছেন গোলগাছের বাগানে। সংগ্রহ করবেন গোলগাছের রস।

অমিত মণ্ডলের পরিবারের মতো পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ৩০০ পরিবার গোলগাছের রস সংগ্রহ করার পর তা দিয়ে গুড় তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই এই মৌসুমে গোলের গুড় তৈরি প্রতিটি পরিবার ৫০-৬০ হাজার টাকা আয় করছে।

কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কলাপাড়ার ৬৫ হেক্টর জমিতে গোলগাছের বাগান রয়েছে। শীতের মৌসুমে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর, নেয়ামতপুর, পাখীমারা গ্রামসহ বেশ কয়েটি গ্রামের বাসিন্দা রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছেন। চলতি মৌসুমে এখান থেকে অন্তত ২০০ টন গোলের গুড় উৎপাদিত হচ্ছে। এই গুড়ের বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা।

গোলগাছের রস দিয়ে গুড় তৈরির সঙ্গে যুক্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লবণাক্ত পলিযুক্ত মাটিতে জন্মানো গোলগাছের কাণ্ড থেকে রস সংগ্রহ করার কৌশল কিন্তু আলাদা। আষাঢ় মাসে গোলগাছের কাণ্ডে ফল ধরে। অগ্রহায়ণে ফল অনেক বড় হলে কাণ্ডটি ভারে কিছুটা নুয়ে পড়লে কাণ্ডটিকে আলতো করে টেনে নুইয়ে মাটির কাছাকাছি নিয়ে নিচ থেকে টানা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। 

কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ আর এস সাইফুল্লাহ প্রথম আলোকে জানান, গোলগাছের পাতাগুলো নারকেলপাতার মতো লম্বা। নোনাজল ও মাটি ছাড়া গোলগাছ হয় না। গোলগাছের শরীরজুড়েও নোনতা স্বাদ। কিন্তু এই গাছেই মজুত থাকে সুমিষ্ট গাঢ় রস। এই রস জ্বালিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু গুড়। তিনি আরও বলেন, গোলগাছে পরিচর্যা করতে তেমন কোনো খরচ নেই। গুড় উৎপাদন ছাড়াও রয়েছে এ গাছের বহুবিধ ব্যবহার। 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহাবুবুল হক পাটওয়ারী গত শনিবার সকালে কলাপাড়ার নীলগঞ্জে মাঠ পরিদর্শন ও চাষিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এলাকার গোলচাষিদের কাছ থেকে তাঁদের তৈরি গুড়ের গুণগত মানের কথা শোনেন। এ সময় চাষিরা গুড়ের বিপণন নিয়ে সমস্যার কথা জানান।

এ ব্যাপারে অতিরিক্ত সচিব মো. মাহাবুবুল হকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ সুগার ক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট গোলগাছ পরিচর্যা থেকে শুরু করে গুড় তৈরি করার আধুনিক পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন। মার্কেটিংয়ের বিষয়টি আসলে গোলের রস দিয়ে যে গুড় তৈরি হবে, নিশ্চয় এটির আলাদা ভ্যালু হবে। বাজারমূল্য অন্যান্য গুড়ের তুলনায় বেশি হওয়ার কথা। এই গুড় নিয়ে ব্র্যান্ডিং করতে বেসরকারিভাবে যদি কোনো উদ্যোগ থাকে, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।’

গত শনিবার ভোরে সরেজমিনে দেখা যায়, নবীপুর গ্রামের পরিমল হালদার ও তাঁর স্ত্রী সুনীতি হাওলাদার তাফালে আগুন জ্বালিয়ে ডোঙায় রস দিয়ে গুড় তৈরি করছেন। বংশপরম্পরায় গুড় তৈরি করে আসছেন বলে জানালেন সুনীতি। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর থেকেই আমার শাশুড়িকে দেখি প্রতিবছর এই সময়ে রস জ্বাল দিতে। আবার তা দিয়ে গুড় তৈরি করতে। শাশুড়ি রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করার নিয়ম আমাকে শিখিয়েছে। এখন আমি রস দিয়ে গুড় তৈরি করতে পারি।’

সুনীতি জানান, তাঁদের নিজেদের বাগান নেই, অন্যের বাগানের ২৭০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন তাঁরা। এর জন্য বাগানমালিককে মৌসুমে ২৭০ কেজি গুড় দিতে হবে তাঁদের। নিজের ছেলে বিনয় ও দুজন শ্রমিক মিলে রস সংগ্রহ ও বাজারজাত করছেন তাঁরা।

সুনীতির মেয়ে শিখা স্নাতকের শিক্ষার্থী। তিনিই গুড়ের বেচাবিক্রির হিসাব রাখছেন। শিখা জানান, তাঁর বাবা-মা বর্গাচাষি। মৌসুমের তিন মাস গোলের রস সংগ্রহ ও বাড়িতে রস জ্বাল দিয়ে গুড় উৎপাদন করছেন। প্রতিদিন ৮ কলসের মতো রস সংগ্রহ করছেন তাঁরা। তিন ঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার পর ১৫ থেকে ১৭ কেজি গুড় তৈরি হয়। খুলনা, পাবনা ও ঢাকা থেকে কিছু ব্যবসায়ী মুঠোফোনে দাম ঠিক করেন।

পরে তাঁদের কাছে গুড় পাঠানো হয়। তবে ব্যবসায়ীরা তেমন না আসায় গুড়ের দাম বাড়ছে না। এ বছরও ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় গুড় বিক্রি হচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই গুড়ের দাম আরও বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু বিপণনের কৌশল জানা না থাকায় তাঁরা বেশি দামে গুড় বিক্রি করতে পারছেন না।