কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলার প্রধান সড়কের পাশে পানি চলাচলের পুরোনো একটি খাল ভরাট করে সেখানে ‘সিটি পার্ক’ গড়ে তুলছেন উত্তর ধূরুং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল হালিম সিকদার। ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে খাল ভরাট করে গড়ে তোলা পার্কের এক পাশে বাস টার্মিনাল, যাত্রীছাউনি, দোকানপাট, টয়লেট এবং অন্য পাশে ফুলের বাগান তৈরির প্রস্তুতি চলছে।
খাল ভরাটের কারণে স্লুইসগেট বন্ধ হয়ে পানি চলাচলের সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাতে ধান ও লবণ চাষ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে কুতুবদিয়া দ্বীপ হুমকির মুখে। তার ওপর খাল দখলের মতো পরিবেশ বিনাশী কর্মকাণ্ড দ্বীপটিকে আরও বড় ঝুঁকিতে ফেলেছে।
উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যমতে, শত বছর আগেও কুতুবদিয়ার আয়তন ছিল ২১৫ দশমিক ৮০ বর্গকিলোমিটার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে দ্বীপটি ভাঙতে ভাঙতে এখন প্রায় ৪৫ বর্গকিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও পরবর্তী সময়ে ঘটা দুর্যোগে দ্বীপের অন্তত সাত হাজার একর জমি সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যায়। এতে গৃহহীন হন অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। তাঁরা দ্বীপ ছেড়ে বর্তমানে কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়াসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন।
কুতুবদিয়ায় ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ভেতরের জায়গায় বর্তমানে বসবাস করছে ১ লাখ ৫৭ হাজার মানুষ। দ্বীপের মধ্যভাগে লেমশিখালী জেটিঘাট থেকে উত্তর ধূরুং ইউনিয়নের আকবরবলী ঘাট পর্যন্ত প্রধান সড়কটির (আজম রোড) দৈর্ঘ্য প্রায় ১৯ কিলোমিটার। বেশ কিছুদিন ধরে ধূরুং বাজারের উত্তর পাশে তিন রাস্তার সংযোগ স্থলে খালের বিশাল অংশ ভরাট করা হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা থেকে ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে এনে খালে ফেলা হচ্ছে। দুটি খননযন্ত্র দিয়ে সেই মাটি খালে মেশানো হচ্ছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে খাল ভরাটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন উত্তর ধূরুং ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল হালিম সিকদার।
প্রকাশ্যে পুরোনো খাল ভরাট করায় ধান ও লবণ চাষ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি হচ্ছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুতুবদিয়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, খালের আশপাশে প্রায় সাত শ একর লবণ ও ধানের জমিতে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রায় তিন শ একর ধানের জমি রয়েছে।
সরকারি খাল ভরাটের কথা স্বীকার করে উত্তর ধূরুং ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল হালিম সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ঘরবাড়ি তৈরির জন্য খাল ভরাট করা হচ্ছে না। এখানে তৈরি হবে দৃষ্টিনন্দন সিটি পার্ক; যেখানে থাকবে বাস টার্মিনাল, যাত্রীছাউনি, টয়লেট ও ফুলের বাগান। জনগণের দুর্ভোগ লাঘব এবং সড়কের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য সিটি পার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। সড়কে নির্মাণ করা হবে বঙ্গবন্ধুর নামে বড়সড় একটি গেট। মাটি ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণের বিপরীতে ইতিমধ্যে তিনি ১৫ লাখ টাকার বেশি খরচ করে ফেলেছেন, আরও টাকা খরচ করবেন।
কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস করে, পানি চলাচলের রাস্তা ভরাট করে সিটি পার্ক নির্মাণের বৈধতা প্রসঙ্গে ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, আগের ইউএনও দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা সড়কের যানজট নিরসনে খাল ভরাট করে বাস টার্মিনাল নির্মাণের জন্য তাঁকে মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বর্তমান ইউএনও রাশেদুল ইসলামও সিটি পার্ক নির্মাণের বিষয়ে অবগত আছেন।
সরকারি খাল ভরাট করে সিটি পার্ক নির্মাণ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাশেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খালের পরিত্যক্ত একটি অংশ ভরাট করে সেখানে বাস টার্মিনাল ও যাত্রীছাউনি করার মৌখিক নির্দেশনা আগের ইউএনও দিয়েছিলেন বলে জেনেছি। কথা ছিল পরিত্যক্ত অথবা ভরাট খাল খনন করে সেই মাটি দিয়ে এই খাল ভরাট করতে হবে। এখন ফসলি জমির টপ সয়েল কেটে খাল ভরাট করা হচ্ছে কি না, জানা নেই। তা ছাড়া খালের স্লুইসগেট বন্ধ করে পানি চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করারও কথা ছিল না। সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ক্ষতিকর কিছু হয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’