বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আইন লঙ্ঘন করে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছিল। ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায় পুলিশের ছোড়া একটি বুলেট দলিল উদ্দিনের (৩৫) চোয়ালের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ভেঙে যায় দাঁত ও মাড়ি। ছিঁড়ে যায় জিহ্বা। সেই থেকে মুখে খাওয়া ও কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন এই যুবক। এক মাস ধরে ইশারায় ও কাগজে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করছেন তিনি।
দলিল উদ্দিনের অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক মো. আবদুল হান্নান বলেন, ‘মুখের ভেতরে বুলেট ঢুকে বড় ধরনের ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে, যা রিপিয়ারিং করা হয়েছে। একটি সময় পর দলিল উদ্দিন কথাও বলতে পারবেন। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন।’
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে দামুড়হুদার দশমীপাড়ার বাড়িতে গেলে দলিল উদ্দিন কাগজে লিখে বলেন, ‘আমি সুস্থ হতে চাই, আমি কথা বলতে চাই, মানুষের সাথে চলতে চাই, আমি কর্মজীবনে ফিরতে চাই।’
দলিল উদ্দিন চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা দশমীপাড়ার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মো. নূর উদ্দিনের তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাসের পর ২০১৪ সালে উত্তরার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরিতে যোগ দেন। ২০২২ সালে ছোট পরিসরে গার্মেন্ট পণ্যের যৌথ ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর স্ত্রী সিনথিয়া আরমিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। স্বামী-স্ত্রী উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের ফায়দাবাদে আট বছর ধরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন।
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় স্ত্রী সিনথিয়া আরমিন নল দিয়ে তরল খাবার খাওয়াচ্ছেন দলিলকে। দলিলের চোখেমুখে যন্ত্রণার ছাপ। পাশেই বসে বৃদ্ধ বাবা মো. নূর উদ্দিন ছেলেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। সিনথিয়া জানান, উত্তরায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা আন্দোলন শুরু করলে দলিল উদ্দিন তাতে যোগ দেন। নিয়মিত কর্মসূচিতে অংশ নেন। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে তিনি ৫ আগস্ট বিমানবন্দর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান নেয়। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবরে ছাত্র-জনতা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠলে সেখানে থাকা পুলিশ তাঁদের ওপর নির্বিচার গুলি ছোড়ে। এতে একটি বুলেট দলিলের ডান কানের নিচে চোয়াল ভেদ করে মুখের দাঁত ও মাড়ি ভেঙে যায়, ছিঁড়ে যায় জিহ্বা। বাঁ চোয়ালে বেঁধে থাকা বুলেট নিজ হাতে টেনে বের করেন দলিল উদ্দিন। যা পরে কুর্মিটোলা হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে জমা দেওয়া হয়।
সিনথিয়া জানান, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালে সাত দিন চিকিৎসার পর ডান চোয়ালে সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর তাঁকে মিরপুরে বেসরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নিয়ে ১৯ আগস্ট দামুড়হুদার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
সিনথিয়া বলেন, অস্ত্রোপচারের পর থেকেই ওষুধ ও তরল খাবার ছেঁকে নাকের ছিদ্রে বসানো পাইপ দিয়ে পেটে প্রবেশ করানো হচ্ছে। বর্তমানে ডেন্টাল সার্জন আবদুল হান্নানের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন আছে। অস্ত্রোপচারের পর এই এক মাস ধরে লিখে অথবা ইশারায় মনের ভাব প্রকাশ করছেন দলিল।
দলিলের বাবা মো. নূর উদ্দিন বলেন, ‘এক মাস ধরে দলিলের চিকিৎসা চালাতে তিন লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। নিজেদের সঞ্চিত ও ধারদেনা করে এত দিন চিকিৎসা চালানো হয়েছে।’ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চালাতে হবে; কিন্তু আমার আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় চিকিৎসায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।’