বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার পূর্বে শিয়ালঘুনি গ্রাম। এই গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে অবস্থিত নসরত গাজীর মসজিদ। প্রাচীন এই মসজিদের সীমানায় প্রবেশের প্রধান ফটকে প্রতিষ্ঠাকাল ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দ লেখা থাকলেও মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। অবশ্য মসজিদটি প্রায় ৬০০ বছরের পুরোনো বলেই জানেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, এক গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ চুন, সুরকি ও পাতলা বর্গাকার ইট দিয়ে নির্মিত। মসজিদের ভেতরের দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৫০ মিটার। এর দেয়ালগুলো ১ দশমিক ৪৩ মিটার পুরু। মসজিদের চার কোনায় চারটি অষ্টভুজাকার স্তম্ভ রয়েছে। পূর্ব, দক্ষিণ, উত্তর দিকে গথিক (ইউরোপের শিল্প ইতিহাসে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কাল গথিক শিল্পের কাল) খিলানবিশিষ্ট প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে একটি মিহরাব রয়েছে। এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে ছোট ছোট চারটি মিহরাব ও আলোকবাতি রাখার স্থান রয়েছে। মসজিদটির দেয়াল, কার্নিশ ও স্তম্ভে ফুল–লতাপাতার কিছু অলংকরণ রয়েছে।
ঐতিহাসিক এই মসজিদে এখনো মুসল্লিরা নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। তাঁদের একজন মজিবুল হক চৌধুরী (৭০)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই মসজিদে রমজান মাসে প্রতিদিন ৬০-৭০ জন ইফতার করেন। পাশাপাশি ১০০ জনের ওপরে তারাবিহর নামাজ আদায় করেন। প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া থাকলেও নসরত গাজীর প্রাচীনতম মসজিদের ভেতরটা বেশ ঠান্ডা থাকে। নামাজ আদায় করে বেশ প্রশান্তি পাওয়া যায়।
মজিবুল হক চৌধুরী বলেন, মসজিদটিতে বর্তমানে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. নূরুল হক। ঐতিহাসিক মসজিদ হওয়ায় এখানে বিভিন্ন এলাকা ও দেশের বাইরে থেকে তাবলিগ জামাতের মুসল্লিরা প্রায়ই আসেন।
মসজিদের গায়ে থাকা শিলালিপিটি হারিয়ে যাওয়ার কারণে নির্মাণকাল সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য জানা যাচ্ছে না। ‘বাকেরগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার’–এ ফুল ও লতাপাতার নান্দনিক অলংকরণবিশিষ্ট এই মসজিদের বর্ণনা আছে। গেজেটিয়ারেও মসজিদটির গায়ে থাকা শিলালিপি হারিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। ১৮৮৬ সালে বাকেরগঞ্জের তৎকালীন (বর্তমান বরিশাল জেলা) ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরেট এইচ বেভারেজের লেখা ‘দি ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ’ গ্রন্থেও এই মসজিদের বর্ণনা পাওয়া যায়।
হোসেন শাহী আমলের প্রথম শাসক আলাউদ্দিন হোসেন শাহর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ ছেলে নাসির খান নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ উপাধি নিয়ে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তাঁর শাসনকাল ছিল ১৫১৯ থেকে ১৫৩৩ সাল পর্যন্ত। ধারণা করা হয়, এই সময়ে নসরত গাজী নামের তাঁর এক অনুসারী শিয়ালঘুনি গ্রামে মসজিদটি নির্মাণ করেন।
মুসলিম স্থাপত্যের এ নিদর্শন সরকারের একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত এবং তত্ত্বাবধানে রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মসজিদটির প্রবেশপথের খিলান নকশার সঙ্গে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রবেশপথের খিলান নকশার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের কাস্টোডিয়ান মো. আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, নসরত গাজীর মসজিদটি কত সালে নির্মিত তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এর কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে জনশ্রুতি আছে, এটা ষোড়শ শতকে নির্মিত। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আসার পর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কিছু সংস্কারকাজ করা হয়েছে। তবে অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের কার্যক্রম এখনো চালু না হওয়ায় গোটা বিভাগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো নিয়মিত দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না।