‘হামাদের এখানে এমপি ক্যান্ডিডেটরা আসে না। তার চ্যালারাই আসে। তারাই এমপির হয়ে কথা দিয়ে যায়। বড় রাস্তা থাকি গাঁয়ের রাস্তাটো পাকা করি দিবে তা বারবার শুনি। কিন্তুক ইবার এখুন পর্যন্ত আসে নাই। ভোটের আগেই খালি আসে। কত্ত মিঠা মিঠা কথা বোলে। তারপর সব ভুলে যায়।’ কথাগুলো বলছিলেন সাঁওতাল গ্রামের মাঝি হাড়াম (গ্রামপ্রধান) সুকল টুডু (৬৫)। তাঁর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের বাইপুর গ্রামে।
প্রত্যন্ত এই গ্রামে ৭২টি সাঁওতাল পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে চার-পাঁচটি পরিবারের জমিজমা আছে। অন্যদের বসতভিটাটুকুও নেই। খাসজমিতে থাকেন তাঁরা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উত্তাপ এই গ্রামে পৌঁছায়নি বললেই চলে। শুধু বাইপুর নয়, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গ্রামগুলোতে সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী যান না বলেই তাঁদের অভিযোগ। তাঁরা জানান, মূলত প্রার্থীদের কর্মী–সমর্থকেরা গ্রামে এসে ভোট চান ও প্রতিশ্রুতি দেন। তবে নির্বাচনের পর আর সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয় না।
নাচোল, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট উপজেলা নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন গঠিত। এই আসনে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভোটারের সংখ্যা অন্তত ৩৫ হাজার বলে জানান উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি হিংগু মুরমু। তাঁর বাড়ি নাচোল উপজেলার মহনইল গ্রামে। সংসদ নির্বাচনে সব প্রার্থী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভোটারদের গুরুত্ব দেন না বলে মনে করেন হিংগু মুরমু। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি বিশেষ দলের ভোটার মনে করা হয়। এ জন্য আমরা অবহেলারও শিকার হই। অনেক ক্ষেত্রে ওই বিশেষ দলের লোকদের দ্বারা নিপীড়নের শিকারও হই। বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ভোটের আগে। পরে আর খবর নেওয়া হয় না।’
আমাদের একটি বিশেষ দলের ভোটার মনে করা হয়। আমরা অবহেলারও শিকার হই। অনেক ক্ষেত্রে ওই বিশেষ দলের লোকদের দ্বারা নিপীড়নের শিকারও হই।হিংগু মুরমু, সভাপতি, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম
উদাহরণ দিয়ে হিংগু মুরমু বলেন, নাচোলের জমিনকমিন গ্রাম থেকে কার্তিকপুরের কাঁচা রাস্তাটি দুই কিলোমিটার অথবা কিছু বেশি। রাস্তাটি পাকা করার প্রতিশ্রুতি শুনে আসছি সেই ২০০৮ সাল থেকে। কিন্তু এখনো হয়নি। এবারও হয়তো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে।
একই ধরনের অভিযোগ করেন গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউপির মিরাকাঠাল গ্রামের সাঁওতালদের নেতা জগদীশ সরেন। তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই দেখি উন্নয়ন এসে থমকে দাঁড়ায় আমাদের গ্রামগুলোর (ক্ষুদ্র জাতিসত্তার গ্রাম) কাছে। আমাদের গ্রামে ঢুকতে চাড়ালডাঙ্গা মোড় থেকে চাড়ালডাঙ্গা পূর্বপাড়া জামে মসজিদ পর্যন্ত অর্থাৎ বাঙ্গালীদের গ্রাম পর্যন্ত পাকা রাস্তা এসে থেমে গেছে। আমাদের গ্রাম পর্যন্ত আধা কিলোমিটারের কিছু বেশি রাস্তাটি কাঁচা থেকে গেছে। প্রতিশ্রুতি শুনেই আসছি। কিন্তু সড়ক পাকা হয় না।’
জগদীশ সরেন আরও বলেন, তাঁদের গ্রামের পাশেই বড় একটি পুকুর আছে। পুকুরপাড়ে আছে বহু পুরোনো শ্মশান, খ্রিষ্টানদের কবরস্থান ও কালীমন্দির। এগুলো তাঁরা দাদা-বাবার আমল থেকে ব্যবহার করে আসছেন। এই জমি থেকে তাঁদের উচ্ছেদের চেষ্টা হয়েছে বহুবার। তখন ক্ষমতাসীন নেতা-এমপিদের সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত নির্বাচনের কোনো প্রার্থী তাঁদের গ্রামে আসেননি।
এই আসনে এবার পাঁচজন প্রার্থী রয়েছেন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মু. জিয়াউর রহমান, স্বতন্ত্র প্রার্থী গোমস্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস, জাতীয় পার্টির মোহা. আবদুর রশিদ, বিএনএফের আজিজুর রহমান ও বাংলাদেশ কংগ্রেসের আবদুল্লা আল মামুন।
সংসদ সদস্য মু. জিয়াউর রহমান বলেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময় সব গ্রামে যাওয়া সম্ভব হয় না। ইতিমধ্যে কয়েকটি গ্রামে গেছেন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বিষয়ে তিনি বলেন, এবার নির্বাচিত হলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গ্রামের রাস্তাগুলো যেন কাঁচা না থাকে, সে ব্যবস্থা করা হবে। জমিনকমিন গ্রাম থেকে কার্তিকপুর পর্যন্ত রাস্তাটি শিগগিরই পাকা হবে।