আরিশ আহমেদ
আরিশ আহমেদ

চোখে গুলি লাগায় পাইলট হওয়ার স্বপ্ন শেষ আরিশের

আরিশ আহমেদের (১৫) স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে পাইলট হবে। সেই আশায় বুক বেঁধে প্রবল আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করছিল সে। কিন্তু এখন তার সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কারণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে তার ডান চোখ গুলিবিদ্ধ হয়। এখন সে আর ওই চোখে দেখতে পাবে না।

আরিশ আহমেদের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কুশমাইল ইউনিয়নের কুশমাইল গ্রামে। সে কৃষক আশরাফুল ইসলামের ছেলে। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে ছোট। আরিশ ফুলবাড়িয়া উপজেলার শহীদ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

স্বজনেরা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট আসরের নামাজের পর পরিবারের কাছে খবর আসে আরিশ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ফুলবাড়িয়া উপজেলার আছিম-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ইব্রাহীম মার্কেট এলাকায় চলমান ছাত্র-জনতার পূর্বনির্ধারিত অবস্থান কর্মসূচিতে গুলিবিদ্ধ হয় আরিশ। চোখ, মাথা, মুখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ১৩টি ছররা গুলি লাগে। তাকে দ্রুত ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পাঠান। পরে ঢাকার সিএমএইচে চোখের অস্ত্রোপচার করানো হলেও ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি আর ফিরে আসেনি।

আজ শুক্রবার সকালে আরিশ আহমেদের সঙ্গে কথা হয় ময়মনসিংহ নগরের জয়নুল আবেদিন উদ্যান এলাকায়। সে প্রথম আলোকে জানায়, ‘২৩ জুলাই থেকে আমি আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতে থাকি। ৪ আগস্ট গণিত প্রাইভেট পড়া শেষে বাড়িতে গিয়ে বই রেখে ভাত খেয়ে আন্দোলনে যোগ দিতে যাই। বেলা তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার দিকে একদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা, অন্যদিকে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। আমরা আগাতে চাইলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। আমরা আগুন ধরিয়ে কিছুটা সুস্থ বোধ করে আবার এগিয়ে যেতে চাইলে ছররা গুলি ছুড়তে শুরু করে। আমি দৌড়াতে শুরু করলে দেখি চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। তখন বুঝতে পারি আমার শরীর ও চোখে গুলি লেগেছে। ধীরে ধীরে শরীর নিস্তেজ হতে শুরু করে।’

আরিশ আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চলছে কিন্তু ডান চোখের ভেতরে আটকে থাকা গুলি বের করা যায়নি। দেশের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ‘দেশের বাইরে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করালে হয়তো ভালো হতে পারে। এখনো শরীরে ১৩টি গুলি বয়ে বেড়াচ্ছে সে। গুলি ভেতরে থাকলে সমস্যা নেই, সে কারণে সেগুলো চিকিৎসকেরা বের করছেন না। কিন্তু চোখের ভেতরে আটকে থাকা গুলি সব সময় যন্ত্রণা দেয়, চোখে ব্যথা করে। গুলি লাগার পর থেকেই চোখে দেখতে পারছি না।’

আরিশ বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য সরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি। শুধু বলে সহযোগিতা করবে, কিন্তু আমি কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমার বাবা মানুষের কাছ থেকে ধার করে আমার চিকিৎসা করাচ্ছেন, ঘরে ধান ছিল তা বিক্রি করেছে।’

পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিল জানিয়ে আরিশ আহমেদ বলে, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল পাইলট হব, সেই প্রস্তুতি নিয়েই পড়ালেখা করছিলাম। কিন্তু আমার এক চোখ দিয়ে দেখতে পাই না, এখন আর পাইলট হওয়া যাবে না। সরকারের কাছে চাওয়া, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের যেন উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হয়। যদি দেশের বাইরে নিতে হয়, তাহলে যেন তা–ই করা হয়।’

বাবা আশরাফুল ইসলাম বলেন, আরিশের ডান চোখে দুটি গুলি কর্নিয়ার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। গুলি বের করতে হলে চোখ কাটাছেঁড়া করতে হবে, তাতে দৃষ্টি ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। এখন সৌন্দর্য হিসেবে চোখটি রাখা হয়েছে।

আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘ছোটবেলায় আকাশে বিমান উড়তে দেখে ছেলে বলত ওটা কী, আমি বলতাম উড়োজাহাজ। ছেলে জানতে চাইত, এটা কে চালায়, আমি বলতাম মানুষে চালায়। ছেলে বলত, বড় হয়ে পাইলট হয়ে বিমান চালাব। কিন্তু আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর হামলা ও গুলি চালানোর ঘটনায় আরিশ আহমেদের বাবা গতকাল বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ আদালতে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা করেছেন। মামলায় ফুলবাড়িয়া আসনের আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল মালেক সরকার, থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাশেদুজ্জামানসহ পুলিশের চার উপপরিদর্শকসহ (এসআই) ৩৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ১৫০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়।

ময়মনসিংহ আদালত পরিদর্শক পিএসএম মোস্তাছিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মামলার আবেদনটি আমলে নিয়ে ফুলবাড়িয়া থানাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত।