মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘিরে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে তাণ্ডব চালান দলটির নেতা-কর্মীরা। ওই দিন নাটোরের লালপুরে বাড়িতে হামলা করে যুবলীগ নেতা খাইরুল ইসলামকে (৩৭) হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলাটি একপর্যায়ে উচ্চ আদালতে আটকে ছিল। অবশেষে ঘটনার ১০ বছর পর আজ মঙ্গলবার শুনানি শেষে ২৬ নভেম্বর মামলাটির রায়ের দিন ধার্য করেছেন রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আদালত।
বিষয়টি নিশ্চিত করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আসলাম সরকার বলেন, আজ আদালতে শুনানির সময় খাইরুলের স্ত্রী লিপি খাতুন ও তাঁর দুই সন্তান উপস্থিত ছিলেন। মামলার ৬৭ আসামির মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। একজন বিদেশে পালিয়ে গেছেন। দুজন অনুপস্থিত ছিলেন। বাকি আসামিরা আজ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
নিহত খাইরুল লালপুর উপজেলার কদিমচিলান ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পেশায় নিরাপত্তাপ্রহরী খাইরুল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ঘটনার সময় তাঁর ছেলে জুবায়ের সপ্তম শ্রেণিতে ও মেয়ে খাদিজাতুল কুবরা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। তাঁর স্ত্রী লিপি খাতুন তিন মাসের সন্তানসম্ভবা ছিলেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী থেকে জানা যায়, খাইরুল ঘটনার দিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। বাইরে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ শুনে তিনি ঘর থেকে বের হন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকজন খাইরুলকে ঘিরে ধরেন। তাঁরা রামদা, চায়নিজ কুড়াল দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খাইরুলকে হত্যা করেন। খাইরুলকে বাঁচাতে তাঁর চাচা মজনু ও জলিল এগিয়ে এলে তাঁদেরও কোপানো হয়।
এ ঘটনায় ২০১৩ সালের ২০ মার্চ প্রথম আলোতে ‘দুই সন্তানের চোখে এখন শুধুই অন্ধকার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখন খাইরুলের স্ত্রী লিপি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁর স্বামীর মুখে দাড়ি ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। সেদিনও জোহরের নামাজ পড়ে এসে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি নৌকায় ভোট দিতেন। সংবাদ প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাইরুলের স্ত্রীর নামে ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র খুলে দেন। এর মুনাফা দিয়ে তাঁদের সংসার চলে।
হত্যার ঘটনায় খাইরুলের ভাই শাহীনুর রহমান বাদী হয়ে লালপুর থানায় একটি মামলা করেন। শুরুতে তদন্তের কাজ ভালোভাবে চললেও অজানা কারণে বছর পার হলেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয় না। অনেক টালবাহানার পর দেড় বছরের মাথায় পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়। ছয়জনের সাক্ষ্য শেষ হওয়ার পর ২০১৭ সালে আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে রিট করলে মামলাটি স্থগিত হয়ে যায়।
খাইরুলের সেই ছোট্ট ছেলে জুবায়ের হোসেন এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। তাঁর বোন খাদিজাতুল কুবরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন।
জুবায়ের প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ আদালতে মামলার স্থিতাবস্থা জারির পর তাঁরা কোনো কিনারা করতে পারছিলেন না। ২০১৮ সালে নির্বাচনের পর স্থানীয় সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলামের মাধ্যমে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মামলার বিষয়ে খুলে বলেন। পরে জানা যায়, মামলার নথি ‘মিসিং’ হয়ে আছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও নথি পাওয়া যাচ্ছিল না।
জুবায়ের আরও বলেন, সংসদ সদস্য পরে তাঁদের নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে যান। পরে তাঁর মাধ্যমে এক সহকারী রেজিস্ট্রারের চেষ্টায় দীর্ঘ দুই বছর পর নথি উদ্ধার হয়। পরে উচ্চ আদালত স্থিতাবস্থা তুলে নিলে রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি আবার চালু হয়।
তিনি বলেন, মামলার বিচার কার্যক্রম শুরুর পর থেকে আসামিপক্ষ মীমাংসা করার জন্য নানাভাবে চাপ দিয়েছে। বাদীকে বেশ কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করেছে। এরপর বাড়ি ছেড়ে তিনি ঢাকায় অবস্থান নিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।