মানিকগঞ্জ শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল খনন এবং সৌন্দর্যবর্ধনকাজের তেমন অগ্রগতি নেই। গত শনিবার দুপুরে গঙ্গাধরপট্টি এলাকায়
মানিকগঞ্জ শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল খনন এবং সৌন্দর্যবর্ধনকাজের তেমন অগ্রগতি নেই। গত শনিবার দুপুরে গঙ্গাধরপট্টি এলাকায়

মানিকগঞ্জে খাল খনন ও শোভাবর্ধন কাজের মেয়াদ বাড়ে, গতি বাড়ে না

মানিকগঞ্জ শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল খনন ও শোভাবর্ধনের কাজ শুরু হয় ২০২২ সালের মাঝামাঝি। গত বছরের জুনে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে আরও এক বছর প্রকল্পের মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়ানো হলেও এখনো এক–তৃতীয়াংশের বেশি কাজ বাকি। প্রকল্পের মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়লেও বাড়েনি কাজের অগ্রগতি।

প্রকল্পটির কাজ দ্রুত শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। কাজ শেষ না করে ঠিকাদার লাপাত্তা হওয়ায় প্রকল্পের কাজ কত দিনে সম্পন্ন হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, খালটি খনন ও শোভাবর্ধনের কাজের মেয়াদ বাড়িয়েও যথাসময়ে কাজ শেষ করতে পারেননি ঠিকাদার। কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৬৫ শতাংশ। এর আগে ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত খালটি খনন ও সৌন্দর্যবর্ধনে ১৮ কোটি ২৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। নতুন করে আবার খনন, শোভাবর্ধন ও দুটি সেতু নির্মাণে ২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই বিপুল অর্থ খরচ করে প্রকল্পের সুফল নিয়ে স্থানীয় লোকজন সন্দিহান।

খালের কাজ সম্পন্ন করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
মো. গিয়াস উদ্দিন, নির্বাহী প্রকৌশলী, মানিকগঞ্জ পৌরসভা

মানিকগঞ্জ পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মানিকগঞ্জ পৌরসভার বান্দুটিয়ার কালীগঙ্গা নদী থেকে খালটি উৎপত্তি হয়ে সন্তোষপুর এলাকায় পুনরায় কালীগঙ্গায় মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ১৫০ মিটার। খালটির খনন ও শোভাবর্ধনে ‘সেকেন্ড সিটি রিজিয়ন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ প্রকল্প হাতে নেয় পৌর কর্তৃপক্ষ। এ প্রকল্পের অধীন খাল খনন, দুই পাড়ে সিসি ব্লক স্থাপন, নিরাপত্তা দেয়াল (গাইড ওয়াল), দুটি পদচারী–সেতু, একটি সেতু, খালের উভয় পাশে আরসিসি পাইপ দিয়ে ড্রেন নির্মাণ, একটি পাবলিক শৌচাগার নির্মাণ ও হাঁটার রাস্তা নির্মাণ করা হবে। যৌথভাবে এ প্রকল্পের কাজের দায়িত্ব পায় মেসার্স অ্যাপেক্স এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স কামরুল অ্যান্ড ব্রাদারস। তবে মূলত মেসার্স অ্যাপেক্স এন্টারপ্রাইজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্পটির কাজ বাস্তবায়ন করছে। এ কাজের চুক্তিমূল্য ধরা হয় ২৫ কোটি ১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১০ মে প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং শেষ হওয়ার সময় ছিল গত বছরের ১০ মের মধ্যে। পরে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ২৮ কোটি ৫৬ লাখ ৮২ হাজার ৯৩১ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি কাজের মেয়াদও বাড়িয়ে চলতি বছরের ৩০ জুন নির্ধারণ করা হয়। ইতিমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটিকে ১৪ কোটি ৮০ লাখ ৩৯ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে, যা চুক্তিমূল্যের ৫১ শতাংশ।

গত শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, দুটি পদচারী–সেতুর মূল কাজ শেষ হলেও র‌্যামের কাজ বাকি। শহর বাজার এলাকায় সেতুর কাজ শেষ হয়েছে, তবে সংযোগ সড়কের কাজ করা হয়নি। শৌচাগারের কাজও শেষ হয়নি। খালের দুই পাশে আরসিসি পাইপ দিয়ে ড্রেনের কাজও শেষ হয়নি। এ ছাড়া পুলিশ সুপারের বাংলো থেকে বাজার সেতু পর্যন্ত ১ হাজার ৪১৫ মিটার অংশ খনন ও গাইড ওয়াল এবং সিসি ব্লক বসানোও হয়নি। আরও দেখা গেছে, খালটি ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে খালটি এখন মশা-মাছি ও পোকামাকড়ের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে।

প্রকল্পের সুফল নিয়ে সন্দিহান

খালপাড়ের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, বান্দুটিয়ায় খালের উৎসমুখে জলকপাট দিয়ে কালীগঙ্গা নদী থেকে খালে পানি ঢোকে। কিন্তু জলকপাটের কাছে নদী ভরাট হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি বাড়লে খালে পানি ঢুকতে পারে না। এতে বছরের অধিকাংশ সময় খালটি পানিশূন্য থাকে। একইভাবে সন্তোষপুরে খালের শেষ প্রান্তে জলকপাটের ভাটিতে কালীগঙ্গা নদী ভরাট হওয়ায় পানি বের হতে পারে না। এতে খালে পানি ঢুকলে তা বের হতে পারে না। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত খাল খনন ও সৌন্দর্যবর্ধনে ব্যয় হয় প্রায় ১৮ কোটি টাকা। সে সময়ও খালের উৎসমুখ খনন করা হয়নি। ফলে খনন করেও সারা বছর পানিপ্রবাহ রাখা সম্ভব হয়নি। উল্টো বর্ষা মৌসুমের পানির সঙ্গে পলি ঢুকে কিছুদিনের মধ্যে খালটি ভরাট হয়ে যায়। এদিকে নিম্নমানের কাজের কারণে কিছুদিনের মধ্যে খালের বাঁধাই করা পাড়ের সিসি ব্লক ধসে পড়ে। পানিপ্রবাহ না থাকায় শহরের বাসাবাড়ি, হোটেল–রেস্তোরাঁর বর্জ্যে মূলত ভাগাড়ে পরিণত হয় খালটি। এবারও খালটির উৎসমুখ খনন না করে ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আবার খালটি খনন ও শোভাবর্ধনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জ নগর পরিচালন উন্নতিকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন সমন্বয় কমিটির সদস্য ও খালপাড়ের বাসিন্দা গোলাম ছারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, এর আগে প্রায় ১৮ কোটি টাকা ব্যয় করলেও কয়েক বছরের মধ্যে খালটি আবার ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়। নতুন করে বিপুল অর্থের প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তবে কর্তৃপক্ষের তদারকি ও ঠিকাদারের গাফিলতিতে প্রকল্পটির কাজ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া সঠিক পরিকল্পনার অভাবে বিপুল অর্থ ব্যয়ে প্রকল্পের কাজের সুফল মিলবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অ্যাপেক্স এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হলেন মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সুলতানুল আজম খান। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে। শনিবার প্রকল্পের বিষয়ে কথা বলতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিক কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জ পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, খালের কাজ সম্পন্ন করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে গতকাল শুক্রবার মানিকগঞ্জ শহরে খালের কিছু অংশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বিডি ক্লিন নামের একটি সংগঠন। সকালে এ কাজের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা।