কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম (বাঁয়ে) ও লাকসাম পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি হুমায়ূন কবীর
কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম (বাঁয়ে) ও লাকসাম পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি হুমায়ূন কবীর

কুমিল্লায় দুই বিএনপি নেতা ১১ বছর আগে ‘গুম’, আজও অপেক্ষায় স্বজনেরা

বিএনপির টানা অবরোধ কর্মসূচি চলছিল। সময় ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর। রাত ৯টার দিকে কুমিল্লার লাকসামে বিশেষ অভিযান চালায় র‍্যাব-পুলিশসহ যৌথ বাহিনী। একপর্যায়ে লাকসাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরুর মালিকানাধীন ‘লাকসাম ফ্লাওয়ার মিলে’ ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে আটক করা হয়।

যৌথ বাহিনীর অভিযানের খবর পেয়ে ওই রাতেই সাইফুল ইসলাম, লাকসাম পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ুন কবির পারভেজ ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে লাকসাম থেকে কুমিল্লার উদ্দেশে রওনা করেন। কুমিল্লা-নোয়খালী আঞ্চলিক মহাসড়কের লালমাই উপজেলার হরিশ্চর-আলীশ্বর এলাকায় পৌঁছালে সাদাপোশাকধারী একদল লোক অ্যাম্বুলেন্সের গতি নিয়ন্ত্রণ করেন। র‍্যাব পরিচয়ে দিয়ে ওই তিন বিএনপি নেতাকে অন্য একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে কুমিল্লার দিকে নেওয়া হন তাঁরা।

পরে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে জসিম উদ্দিন ও লাকসামে আটক হওয়া ৯ জনকে লাকসাম থানায় হস্তান্তর করে র‍্যাব। পরদিন ২৮ নভেম্বর সকালে ওই ১০ জনকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। এর পর থেকে বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবিরের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

ঘটনার পর থেকেই পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, স্থানীয় বিএনপির ওই দুই শীর্ষ নেতাকে র‍্যাব সদস্যরা অপহরণের পর গুম করেছেন। অপহরণ ও গুমের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৮ মে র‍্যাবের ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কুমিল্লার আদালতে একটি মামলা করেন হুমায়ুন কবিরের বাবা রঙ্গু মিয়া। থানা–পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও তাতে নারাজি দিয়েছেন বাদী। কয়েক দফা তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একবারও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট ছেলে হারানোর শোকে মারা যান মামলার বাদী রঙ্গু মিয়া। বর্তমানে রঙ্গু মিয়ার ছোট ছেলে গোলাম ফারুক মামলাটির বাদী।

ওই মামলার আসামিরা হলেন র‍্যাব-১১–এর বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া সাবেক অধিনায়ক (সিইও) ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, র‍্যাব-১১–এর তৎকালীন কুমিল্লা ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি অধিনায়ক-২ মেজর শাহেদ হাসান (রাজীব), উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) শাহজাহান আলী, উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী সুলতান আহমেদ ও অসিত কুমার রায়।

আমাদের তিনজনকে আটকের পর চোখ বেঁধে ফেলা হয়। ওই দিন মধ্যরাতে চোখ খোলার পর দেখি, আমি লাকসাম থানায় রয়েছি। তখন চারদিকে খোঁজ করেও হিরু (সাইফুল) ও হুমায়ুন ভাইকে দেখতে পাইনি।
জসিম উদ্দিন, অ্যাম্বুলেন্সে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কথিত ‘আয়নাঘর’ থেকে গুম হওয়া একাধিক ব্যক্তি ফিরে আসার খবরে তৎপর হয়ে ওঠেন লাকসামের ওই দুই বিএনপি নেতার পরিবারের সদস্যরা। তবে সাইফুল ও হুমায়ুন বেঁচে আছেন—এমন কোনো আশ্বাস পাননি তাঁরা।

এ সম্পর্কে নিখোঁজ হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে র‍্যাবই এই গুম করেছে। লাকসামের এই শীর্ষ দুই নেতাকে গুম করার মূল কারণ হলো রাজনীতি। তাঁদের সরিয়ে প্রতিপক্ষ দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতা লাভবান হয়েছিলেন। রাজনীতির প্রেক্ষাপট সামনে এলেই আমরা গুমের নেপথ্যে থাকা অদৃশ্য “নূর হোসেনকে” কল্পনা করতে পারি। তবে তিনি এখনো আড়ালে আছেন।’

সেদিনের ঘটনার কথা বলতে গেলে এখনো আঁতকে ওঠেন অ্যাম্বুলেন্সে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের তিনজনকে আটকের পর চোখ বেঁধে ফেলা হয়। ওই দিন মধ্যরাতে চোখ খোলার পর দেখি, আমি লাকসাম থানায় রয়েছি। তখন চারদিকে খোঁজ করেও হিরু (সাইফুল) ও হুমায়ুন ভাইকে দেখতে পাইনি। আমাকে র‍্যাব থানায় দিয়ে গেছে। তার মানে তাঁদের র‍্যাবই গুম করেছে। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।’

অপহরণ ও গুমের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৮ মে র‍্যাবের ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কুমিল্লার আদালতে একটি মামলা করেন হুমায়ুন কবিরের বাবা রঙ্গু মিয়া। থানা–পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও তাতে নারাজি দেন বাদী। কয়েক দফা তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একবারও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।

এখন পর্যন্ত যাঁরা মামলাটির তদন্ত করেছেন, তাঁদের কেউই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি বলে জানিয়েছেন বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী মুহাম্মদ বদিউল আলম। তাঁর ভাষ্য, আগে যাঁরা মামলাটির তদন্ত করেছেন, তাঁদের কেউ চাননি মামলাটি আলোর মুখ দেখুক। এ জন্য তাঁরা তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ করেছেন।

বদিউল আলম বলেন, ‘শুরু থেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠিত হয়েছে। সেখানে সব তথ্য-উপাত্ত জমা দেওয়ার কাজ শুরু করেছি।’

বদিউল আলম জানান, মামলাটির প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন কয়েক দফা সময় নিয়ে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর মনগড়াভাবে আদালতে দাখিল করে লাকসাম থানার পুলিশ। পরে পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দিলে ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি আদালত মামলাটি সিআইডিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। সিআইডি সাড়ে ৫ বছরে অন্তত ৬৩ বার আদালত থেকে সময় নিয়ে মনগড়া ও মিথ্যা প্রতিবেদন দাখিল করে ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট। এরপর পিবিআইও একই কাজ করেছে।

নিখোঁজ সাইফুল ইসলামের একমাত্র ছেলে রাফসাল ইসলাম বলেন, ‘অপহরণ ও গুমের একজন প্রত্যক্ষদর্শী তো আছেই। র‍্যাব তাঁকে থানায় পাঠিয়ে বাকি দুজনকে গুম করেছে—বিষয়টি পরিষ্কার। তারেক সাঈদ এই গুমের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে আমরা বিশ্বাস করি। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বেরিয়ে আসবে। ওই ঘটনায় থানা–পুলিশ মামলা নেয়নি। ওই সময় একটি জিডি করা হলেও সেটিরও তদন্ত হয়নি।

নিখোঁজ হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী শাহনাজ আক্তারের দাবি, ঘটনার পর পরিবারের সদস্যরা একাধিকবার চেষ্টার পর তারেক সাঈদের সঙ্গে একবার দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তখন তারেক সাঈদ তাঁদের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন। এরপর তাঁরা তাজুল ইসলামের সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। বারবার আকুতি-মিনতি করেও কোনো কাজ হয়নি।

শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘আমরা আজও জানি না তাঁদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছে। আমরা জানতে চাই, তাঁরা কি জীবিত, নাকি মেরে ফেলা হয়েছে? অন্তত এইটুকু জানার অধিকারও কি আমাদের নেই?’

অনেকে আয়নাঘর থেকে ফিরে এসেছেন—এ খবর পেয়ে আমরা ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছি। কিন্তু এখনো কোনো হদিস মেলেনি আমার ভাইসহ দুই নেতার। এখন কোনো চাপ নেই; তাই আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব তথ্য সামনে আসবে।
গোলাম ফারুক, নিখোঁজ হুমায়ূন কবীরের ভাই

মামলার বর্তমান বাদী ও হুমায়ুনের ছোট ভাই গোলাম ফারুক বলেন, ‘অনেকে আয়নাঘর থেকে ফিরে এসেছেন—এ খবর পেয়ে আমরা ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছি। কিন্তু এখনো কোনো হদিস মেলেনি আমার ভাইসহ দুই নেতার। এখন কোনো চাপ নেই; তাই আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব তথ্য সামনে আসবে।’

এ বিষয়ে মামলাটির বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা কুমিল্লার সহকারী পুলিশ সুপার (লাকসাম সার্কেল) সৌমেন মজুমদার বলেন, ‘বারবার চেষ্টা করেও আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। আসামিরা ওই সময় র‍্যাবে কর্মরত ছিলেন। র‍্যাবের কাছে চিঠি দিয়েও কয়েকজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বর্তমান অবস্থান এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি।’

সৌমেন মজুমদার আরও বলেন, ‘মামলাটির তিনটি প্রতিবেদন ইতিমধ্যে আদালতে জমা হয়েছে। আমরা চাই না মনগড়া কোনো প্রতিবেদন জমা দিতে। এ জন্য কিছুটা সময় লাগছে। শিগগিরই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি চেয়ে চিঠি দেওয়া হবে। এ ছাড়া বাদীপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকেও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হবে।’