লালন ফকিরের ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় তিন দিনব্যাপী সাধুসঙ্গ শুরু হয়েছে। তাঁর আখড়াবাড়ির ভেতরে গান পরিবেশন করছেন বাউলেরা
লালন ফকিরের ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় তিন দিনব্যাপী সাধুসঙ্গ শুরু হয়েছে। তাঁর আখড়াবাড়ির ভেতরে গান পরিবেশন করছেন বাউলেরা

ছেঁউড়িয়ায় লালন উৎসব: যেখানে সাঁইর বারামখানা

দুই দিন আগে থেকেই আখড়াবাড়িতে সাধু–বাউলদের আনাগোনা বেড়েছে। আর গতকাল বৃহস্পতিবার পুরো আখড়াবাড়িতে যেন তিলধারণের ঠাঁই ছিল না। সাধু, বাউলভক্ত আর অনুসারীদের আগমনে অন্য রকম পরিবেশ। ফকির লালন শাহর তিরোধন দিবসে বসেছে তাঁদের মিলনমেলা। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে লালন শাহর কালজয়ী সব গান—‘আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়’, ‘যেখানে সাঁইর বারামখানা’, ‘তিন পাগলে হলো মেলা’, ‘মিলন হবে কত দিনে’।

গতকাল সন্ধ্যা থেকে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন আখড়াবাড়িতে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী লালন মেলা ও সংগীতানুষ্ঠান। লালনের অনুসারী ও ভক্তরা মূলত নিজেদের মতন সাধুসঙ্গ করছেন। গানে গানে স্মরণ করছেন তাঁদের সাঁইজিকে।

বেলা তিনটার দিকে আখড়াবাড়ির দিকে যান এই প্রতিবেদক। দেখা গেল, বহুদূর থেকে সাধু–বাউল ও ভক্তরা আসছেন আখড়াবাড়িতে। অনেকেই এসে পৌঁছেছেন। কারও হাতে একতারা, আবার কারও হাতে দোতারা। সবার পরনে সাদা কাপড়ের পোশাক। সন্ধ্যার পরপরই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বাউলেরা সাঁইজির আরাধনায় মত্ত হয়ে পড়েন। চিরাচরিত গুরুবাদী ধর্মের নিয়মে সূর্য ডোবার পরপরই শুরু হয় অষ্টপ্রহরের গুরুকার্য। বাদ্যযন্ত্রে মুখর হয়ে ওঠে পুরো আখড়াবাড়ি।

সাধুভক্তরা বলছেন, এবার তিন–চার দিন আগে থেকেই সাধুভক্তরা আখড়াবাড়িতে ভিড় করতে থাকেন। আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণ বাদ্যযন্ত্র ও গানে গানে মুখর হতে থাকে। কথা হয় জেলার দৌলতপুর উপজেলার চরসাদীপুর এলাকা থেকে আসা ফকির নবাব শাহর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘গতকাল (বুধবার) এখানে আইসছি। এসে দেখি সাধুগুরুরা সব জাগা নিয়েছে। জাগা (জায়গা) পাইনি। অন্যের আসনে উঠিছি। সবাই আপন করে নিয়েছে।’

নবাব শাহর সঙ্গিনী রেবেকা সুলতানা জানালেন, এবার যেন সাধুরা সবাই মন খুলে ছুটে এসেছে। সবার প্রাণ যেন এই আখড়াবাড়িতে টানছে। জানালেন, দুই দিন থাকবেন এই ধামে।

সেখানে বগুড়া থেকে আসা লুৎফর রহমান বিশ্বাস বললেন, ‘কার্তিকের পয়লা দিন ভুলে থাকা যায় না। যেখানেই থাকি, মন আপন মনেই ছুটে আসে। কোনো বাধাই মানে না। সাঁইজির চরণে আশ্রয় নিতে আমাদের আসা।’

আখড়াবাড়ি ঘুরে দেখা গেল, ছোট ছোট আসন করে বসেছেন সাধু–বাউলেরা। বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করছেন। তাঁদের ঘিরে রয়েছেন দর্শনার্থীরা। মাইক ছাড়াই গলা ছেড়ে এক বাউল গেয়ে উঠলেন, ‘দেখ না মন ঝাঁক মারি, এই দুনিয়াদারি/ তোমার পিছে পিছে ঘুরছে সমন/ কোন দিন হাতে দেবে দড়ি..।’

দর্শনার্থীরা এক জায়গার গান শুনে আরেক স্থানে গিয়ে গান শুনছেন। তবে চারপাশে ছিল ভিড়। মেহেরপুরের ধলা গ্রাম থেকে আসা খয়ের উদ্দীন বললেন, ‘সাঁইজির কাছে না এলে কিছুই ভালো লাগে না। তিনিই আমাকে ডেকে আনেন।’

সন্ধ্যায় কালী নদীর পারে মঞ্চে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার লালন একাডেমির আয়োজনে ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তিন দিনের আয়োজনের উদ্বোধন করেন। কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শারমিন আখতারের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মুহাম্মদ রশিদুজ্জামান।

পরে রাতে লালন একাডেমির শিল্পীসহ অতিথি শিল্পীরা সেখানে মধ্যরাত পর্যন্ত লালনের গান পরিবেশন করেন। কালী নদীর পারে বিশাল মাঠে মেলায় বসেছে শতাধিক অস্থায়ী দোকান। সেখানে মানুষের সমাগম আরও বেশি। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষ লালনের গান শোনার পাশাপাশি মেলায় কেনাকাটাও করছেন।

১৮৯০ সালের ১ কার্তিক কালজয়ী ভাবুক ও শিল্পী লালন সাঁই কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের ছেঁউড়িয়া গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। এর পর থেকে আখড়াবাড়ি চত্বরে তাঁর ভক্ত–অনুসারীরা তাঁদের সাঁইজিকে স্মরণ করে আসছেন। পরে লালন একাডেমি এ আয়োজনের দায়িত্ব নেয়।