বাড়ি পুড়ে ছাই হয়েছে। দাঁড়িয়ে আছে সিমেন্টের খুঁটিগুলো। এবড়োখেবড়ো টিনের চালা। পোড়া ছাইয়ের ভ্যাপসা গন্ধ আর ধ্বংসস্তূপের পাশে শর্ষেগাছের খড়। খড়ের মধ্যে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন মোমিনুল হক (৫৫)। মানুষের শব্দ পেয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে ভাঙা গলায় বলতে শুরু করলেন, ‘কিচ্ছু নেই। সব জ্বলে অঙ্গার হয়ে গেছে। রাতে মসজিদে ছিলাম। ভয়ে ঘুমাতে পারিনি।’
পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ‘সালানা জলসা’ বন্ধের দাবিতে করা বিক্ষোভ থেকে আহম্মদনগর এলাকায় মোমিনুল হকের মতো শতাধিক ব্যক্তির বাড়িঘরে হামলা হয়। আহমদিয়ারা শুক্রবার দুপুরে বাড়িঘরে তালা দিয়ে জলসায় ছিলেন। এ সুযোগে বিকেল থেকেই দুষ্কৃতকারীরা তাঁদের বাড়িঘরে প্রথমে হামলা চালায়। লুট করে নিয়ে যায় সর্বস্ব। পরে বাড়িঘরে আগুন দিয়ে চলে যায় তারা।
আজ রোববার সকালে বাড়ি পুড়ে যাওয়া মানুষদের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। মোমিনুল হক বলেন, তাঁর দুই ছেলে দুই মেয়ে। ছেলেদের একজন ঢাকায় পোশাকশ্রমিকের কাজ করেন। অন্যজন ট্রাকচালক। বড় মেয়ে মাধ্যমিক পাস করেছে। ছোটটা নবম শ্রেণিতে পড়ে। আতঙ্কে গতকাল শনিবার সকালে দুই মেয়েকে ঢাকায় ছেলের কাছে পাঠিয়েছেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলতে শুরু থাকেন, বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। এ মাসের শেষ শুক্রবার। মেয়ের বিয়ের জন্য কিছু টাকাও আলমারিতে রেখেছিলেন। সেসব লুট করা হয়েছে।
আহমদিয়াদের হিসাব অনুযায়ী, আহম্মদনগর এলাকায় ১৫০টি বাড়িতে অগ্নিসংগযোগ করা হয়। দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা হয়। সুজন আহমেদ (৩৪) নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ফুলতলা বাজারে তাঁর সিমেন্টের দোকান ছিল। ট্রলিতে করে সিমেন্টের বস্তাগুলো বের করে নিয়ে দোকানে আগুন দিয়েছে। কথা বলতে বলতে আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া দুই মামা ও দুই চাচার বাড়ি ঘুরে দেখালেন সুজন আহমেদ।
আহম্মদনগরের বাসিন্দারা জানান, ঘটনার পর থেকে এক কাপড়েই আছেন তাঁরা। পোড়া ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পাটি বিছিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শনিবার রাতে আবারও হামলার খবর পেয়ে পরে মসজিদের বারান্দায় ঘুমিয়েছেন। তারপরও আতঙ্ক কাটেনি তাঁদের।
মোজাম্মেল হক (৬০) বলেন, এলাকার সবাই মেয়েমানুষ ও ছোট বাচ্চাদের বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আজ সকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক লোক তাঁদের চিড়া, মুড়ি ও গুড় দিয়ে গেছেন। তবে গত রাতে (শনিবার) প্রতিবেশী এক মুসলিম সম্প্রদায়ের পরিবার তাঁদের খাবার দিয়েছে।
পাড়ার মাঝখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা (৬৭) আবু হানিফের বাড়ি। তাঁর পাকাবাড়ির প্রতিটি কক্ষে আগুন দেওয়া হয়েছে। কক্ষের ভেতরে পড়ে আছে রেফ্রিজারেটরের পোড়া অংশ। দেয়ালে ঝুলে আছে টেলিভিশনের পোড়া অংশ। ওয়ার্ডরোপের একটু অংশ দেখা যাচ্ছে। হানিফ বলেন, বাইরে থেকে প্রধান গেটে তালা দেওয়া ছিল। গেট ভেঙে বাড়িতে ঢুকে আগুন দেওয়া হয়েছে। লুট করা হয়েছে টাকাপয়সা। পাসপোর্টসহ মুক্তিযোদ্ধার যাবতীয় কাগজপত্র।
এদিকে গত তিন দিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোববার সকাল থেকে শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদ নগর এবং তার পার্শ্ববর্তী ফুলতলা ও শালশিরি এলাকায় পুলিশ ও বিবিজির সদস্যদের কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী দেখা গেছে। এর আগে গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর আহম্মদনগর এলাকায় শুরু হওয়া আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী সালানা জলসা বিক্ষোভের মুখে প্রশাসনের অনুরোধে রাতেই বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আহমদিয়া সালানা জলসার আহ্বায়ক আহমদ তবশির চৌধুরী বলেন, বৃহস্পতি ও শুক্রবারের ঘটনার পর শনিবার রাতে আবারও একটি গুজব ছড়িয়ে কিছু বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় শনিবার একটি হত্যাকাণ্ডসহ সব বিষয়ে অজ্ঞাতনামা ৪০০ জনকে আসামি করে পঞ্চগড় সদর থানায় একটি মামলার এজাহার জমা দেওয়া হয়েছে।