গাজীপুর ডায়াবেটিক সমিতিতে প্রতিদিন গড়ে রোগী আসে ৪০০ জন। পাঁচ বছর ধরেই বাড়ছে রোগী। হাসপাতাল না থাকায় ভোগান্তি।
আবদুল আলীমের বাঁ পায়ের একটি আঙুল কেটে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। নতুন করে আরেকটি আঙুলে পচন ধরেছে। আঙুলটি যাতে কাটা না পড়ে, তাই আগেভাবেই চলে এসেছেন চিকিৎসকের কাছে। গাজীপুর ডায়াবেটিক সমিতির ১ নম্বর সেন্টারে অনেকের মধ্যে তিনিও বসে আছেন চিকিৎসক দেখানোর অপেক্ষায়। পাশে মন খারাপ করে বসে আছেন স্ত্রী হাজেরা ও কিশোর বয়সী একমাত্র ছেলে পিয়াস।
আলীম ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ধানখেতে কাজ করতে গিয়ে পরিত্যক্ত কাচে বুড়ো আঙুল হালকা কেটে যায়। সেখানে ঘা ধরে গেলে গত বছরের ডিসেম্বরে অস্ত্রোপচার করে তাঁর আঙুল কেটে ফেলা হয়। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় গত ২৭ অক্টোবর একই পায়ের আরও একটি আঙুলে আঘাত পান তিনি। সেখানেও হালকা পচন ধরেছে। প্রথম অস্ত্রোপচারে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে প্রায় এক লাখ টাকা।
চিকিৎসার টাকা জোগাতে গয়না ও গোয়ালের গরু বিক্রি করে খরচ জোগাতে হয়েছে হাজেরাকে। এবার এত টাকা কোথায় পাবেন, সেটা নিয়েই যেন চিন্তায় দিশাহারা পুরো পরিবার। দুঃখ প্রকাশ করে হাজেরা বলছিলেন, ‘চিকিৎসা করাইতে গিয়া আমাগোর সব শেষ। এহন আর জমিও নাই যে বিক্রি কইর্যা চিকিৎসা চালামু। এহন একমাত্র আল্লাহই আমাগোর ভরসা।’
গত শনিবার গাজীপুর ডায়াবেটিক সমিতির ১ ও ২ নম্বর কার্যালয়ে ঘুরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেক রোগীর দেখা পাওয়া যায়। তাঁদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির।
বাড়ছে রোগী, নেই হাসপাতাল
সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে গাজীপুর জেলার কোথাও কোনো ডায়াবেটিক হাসপাতাল নেই। তবে ঢাকার বারডেম হাসপাতালের অধিভুক্ত (অ্যাফিলিয়েটেড) প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৯৭ সাল থেকে ডায়াবেটিস চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে ডায়াবেটিক সমিতি বহির্বিভাগে রোগী দেখার কার্যক্রম শুরু করে। গাজীপুর নগর ভবন ও শহরের প্রকৌশলী ভবনে দুটি কেন্দ্রের মাধ্যমে এ কার্যক্রম চলছে। এখানে মোট চিকিৎসক রয়েছেন ১২ জন।
সমিতির দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিদিন রোগী আসেন ৩০০-৪০০ জন। এর মধ্যে নিবন্ধিত রোগী প্রায় ৭০ হাজার। পাঁচ বছর ধরেই রোগী বাড়ছে। ২০১৮ সালে রোগী ছিল ৬২ হাজার ৯৭৫ জন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৪ হাজার ৪০০। করোনার ২ বছর ২০২০ ও ২০২১ সালে রোগী কিছুটা কমে। তবে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তা বেড়ে আবার দাঁড়ায় ৬৫ হাজার ৮৯৪ জনে।
চিকিৎসা খরচ মেটাতে কাহিল
গাজীপুর ডায়াবেটিক সমিতিতে চিকিৎসক দেখানো বাবদ কোনো খরচ নেই। তবে সমিতিটিতে রক্ত, মলমূত্র, আলট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রেসহ প্রায় ৩৩ প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। চিকিৎসক দেখাতে আসা রোগীদের প্রায় সবাইকে কোনো না কোনো পরীক্ষা করতে হয়। সে ক্ষেত্রে একজন রোগীর ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার বা তার বেশি টাকা পরীক্ষাবাবদ খরচ হয়ে যায়। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের ফি দিতে হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।
রোগীর স্বজনদের ভাষ্য, কোনো কারণে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে বাধ্য হয়েই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি টাকা খরচ হয়ে যায়।
চাই আরও বেশি সচেতনতা
আজ ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। এ দিন অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের ওপর নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ২০ বছর ধরে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় নিয়োজিত নৃপতি বল্লভ রায়। তিনি গাজীপুর ডায়াবেটিক সমিতির জ্যেষ্ঠ চিকিৎসা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ঘুম কম হওয়া বা পর্যাপ্ত কায়িক পরিশ্রম না করা, অতিরিক্ত চিন্তাসহ নানা কারণে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকে। একমাত্র স্বাস্থ্যসচেতনতাই এ রোগ ও রোগীর সংখ্যা কমাতে পারে।