সরেজমিন ছাতক

খাটের ওপর ভেজা কাঁথা-বালিশ আর কাপড়ের স্তূপ

ঘর থেকে পানি নেমে গেলেও কাদার জন্য হাঁটা দায়। ঘরের ভেতরে ইট ফেলে হাঁটার উপযোগী করছেন আয়জুন নেসা। শনিবার সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে
ছবি: আনিস মাহমুদ

ঘরের ভেতর থেকে পানি নেমেছে। ভেসে উঠেছে বন্যার ক্ষত। মেঝে, বারান্দা এখনো স্যাঁতসেঁতে। নরম কাদামাটিতে পা দিলে দেবে যায়। সবকিছু এলোমেলো হয়ে আছে। খাটের ওপর ভেজা কাঁথা-বালিশ আর কাপড়ের স্তূপ। দুই ছেলের বউকে নিয়ে ভেতরের কাদা লেপে তার ওপর ইট, পলিথিন বিছিয়ে হাঁটার উপযোগী করছিলেন ষাটোর্ধ্ব নছিবুন বেগম।

এই কদিন পরিবারের সবাই আশ্রয় নিয়েছিলেন গ্রামের অন্য এক বাড়িতে। গতকাল শুক্রবার রাতে ঘর থেকে পানি নামায় আজ শনিবার সকালে বাড়িতে এসেছেন। এসেই নতুন করে আবার সবকিছু গোছগাছ করতে কাজে লেগেছেন তাঁরা। সবাই ব্যস্ত। বন্যায় ঘরছাড়া এই নারীদের চোখেমুখে কষ্টের ছাপ।

আজ দুপুরে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে নছিবুন বেগমের বাড়িতে গিয়ে এই চিত্র দেখা যায়। ছাতক উপজেলা শহর থেকে নৌকায় যেতে হয় সীমান্তের ওই গ্রামে। কাজের ফাঁকে নছিবুন বেগম বলেন, ‘পানিয়ে সবতা তছনছ করি গেছে বাবা। কষ্ট বাড়ছে। হাওরের ঢেউয়ে ঘরের বেড়া ভাঙছে। জিনিসপত্র নষ্ট অইছে। টাকাপয়সা নাই, ইতা জুরাইতাম কিলা।’

বন্যার পানিতে সেতু ভেসে থাকলেও ডুবে আছে সড়ক। শনিবার সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে

ভাঙাচোরা টিনের চালা, বাঁশের খুঁটিতে টিনের বেড়ার ঘরটির অবস্থাও নড়বড়ে। ঘরের পূর্বে ও পশ্চিমে হাওর। ঢেউ আছড়ে পড়ে ভিটায়। উঠানের ওপর দিয়ে যে ঢলের প্রবল স্রোত গেছে, সেটি দেখেই বোঝা যায়। নছিবুন বেগমের বড় ছেলের বউ আয়াজুন নেছা জানান, ঈদের দিন রাত একটায় ঘরে কোমরপানি হয়ে যায়। তখন ঝড়বৃষ্টি ছিল। এই অবস্থায় রাতের অন্ধকারে একটি নৌকায় করে ঘর ছাড়েন সবাই। আয়াজুন নেছার শিশুকন্যা রুমেনা (৯) জানায়, তখন খুব ভয় লাগছিল তার।

তাঁদের উঠানের সামনে থাকা এ রকম আরও দুটি ঘরের দরজায় তালা দেওয়া। ঘরের নিচে পানি। বারকি নৌকার শ্রমিক সুরুজ মিয়া ও আবদুল হামিদের পরিবার এখনো ফেরেনি।

নৌকায় করে এলাকার ইসলামপুর, জামুরা, বোয়ালগাঁও, রহমতপুর, রামনগর গ্রাম ঘুরে দেখা গেল, অনেকেই বাড়ি ফিরেছেন। আবার কেউ কেউ এখনো আছেন অন্যের বাড়িতে, আশ্রয়কেন্দ্রে। ইসলামপুর-জামুরা সড়ক, ইসলামপুর-মাদ্রাসা সড়কে তখনো হাঁটুপানি। গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে কয়েকটি পরিবারকে পাওয়া গেল।

বাড়িতে বন্যার পানি। সিতারা বেগমের ঈদ কেটেছে আশ্রয়কেন্দ্রে। বিষন্ন মনে আশ্রয়কেন্দ্রের বারান্দা থেকে বন্যার পানির দিকে তাকিয়ে আছেন। শনিবার দুপুরে ছাতক উপজেলার জামুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

মোকসেনা বেগম নামের এক মধ্যবয়সী নারী স্কুল ভবনের চতুর্থ তলার বারান্দায় পাতা মাটির চুলায় ভাত রান্না করছিলেন। তরকারি কী রাঁধবেন, জানতে চাইলে মাথা নিচু করে বলেন, ‘কয়টা ডাইল আছে।’ মোকসেনার শাশুড়ি সিতারা বেগম জানান, পাঁচ দিন ধরে তাঁরা স্কুলে আছেন। ঘর থেকে এখনো বন্যার পানি নামেনি।

তাজ উদ্দিন নামে গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, স্কুলে ৫০টির মতো পরিবার ছিল। তিনিও পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পানি কমায় এখন সবাই চলে যাচ্ছে। তাঁর পরিবার গত বৃহস্পতিবার বাড়ি ফিরেছেন। আশ্রয়কেন্দ্র স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সুফি আলম ঈদের পরদিন দুই কেজি করে চাল, চিড়া, মুড়ি, চিনি মোমবাতি, স্যালাইন দিয়েছেন। এরপর বিভিন্ন ব্যক্তির পক্ষ থেকে রান্না করা খিচুড়ি, চিড়া-মুড়ি, বিস্কুট দেওয়া হয়েছে। বাকিটা নিজেরাই করেছেন বন্যার্তরা।

গ্রামের আরেক বাসিন্দা সেবুল আহমদ জানান, গতকাল শুক্রবার তাঁর পরিবার আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়েছেন। গ্রামের ২০০ ঘরের মধ্যে ১৫০টির মতো ঘরে পানি ছিল। অনেকের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাহাড়ি ঢল নেমেই আঘাত হানে এসব গ্রামে।

ছাতক শহর থেকেও বন্যার পানি নেমেছে। অনেক দোকানপাটে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে দেখা যায় লোকজনকে। পেপার মিল এলাকার বাসিন্দা রঞ্জন কুমার দাস বলেন, ছাতক শহরে কোমরসমান পানি ছিল। মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ছিলেন। অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বন্যার পানি বাড়িতে ঢুকে পড়ায় ঈদের দিন থেকে ২২টি পরিবার ছাতক-সিলেট পরিত্যক্ত রেললাইনের ওপর ত্রিপল টাঙিয়ে কাটাচ্ছেন।শনিবার দুপুরে ছাতকের সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের তকিপুর গ্রামে

উপজেলা পরিষদে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবকিছু গোছানোর ব্যস্ততা চোখে পড়ে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গোলাম মুস্তাফা সুনামগঞ্জ সদরে গেছেন বলে জানা গেল। উপ প্রশাসনিক কর্মকর্তা জয়দেব চন্দ্র দেবনাথ বলেন, উপজেলা পরিষদ ভবনের নিচতলায় পানি ছিল। পানি নামায় সবকিছু আবার ঠিকঠাক করতে হচ্ছে।

এর আগে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক ধরে ছাতক যাওয়ার পথে সড়কের দুপাশে এখনো অনেক ঘরবাড়ি প্লাবিত দেখা যায়। গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক সড়কটি বন্যার পানির তোড়ে অনেক স্থানে ধসে গেছে। এই সড়কের ওপর দিয়ে বন্যার পানির প্রবল স্রোত গেছে। যান চলাচল বন্ধ ছিল টানা চার দিন। সড়কের সুফিনগর এলাকায় ঢলের পানিতে সড়কের পশ্চিম পাশের বেশ কিছু অংশের মাটি, পাকা ধসে গেছে। বিদ্যুতের খুঁটি, গাছ হেলে পড়েছে। ছাতক আন্ধারীগাঁও এলাকায় ভেঙে গেছে পাকা সড়ক।

ছাতক শহর থেকে ফেরার পথে উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ-সৈয়দেরগাঁও ইউনিয়নের তকিপুর এলাকায় সিলেট-ছাতক পরিত্যক্ত রেললাইনে কয়েকটি ঝুপড়ি চোখে পড়ে। ত্রিপল দিয়ে এসব ঝুপড়ি বানানো হয়েছে। কাছে গিয়ে দেখা গেল, কয়েকটি বন্যার্ত পরিবার এসব ঝুপড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেওয়া সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক আতাউর রহমান জানালেন, ঈদের দিন সকালে গ্রামের ২২টি পরিবার এখানে আশ্রয় নেয়। আশ্রয়কেন্দ্র গ্রাম থেকে দূরে হওয়ায় এখানেই ঝুপড়ি তুলে কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা। যাঁদের ঘর থেকে পানি নেমেছে, তাঁরা চলে গেছেন। সেখানে আশ্রয় নেওয়া মোমিনা বেগম দুঃখ করে বললেন, ‘ইবার ঈদ কিলা গেছে বুঝতাম পারছি না। পথের মাঝে অত দিন ধইরা আছি, কোনো সাহায্য পাইলাম না।’

ভারী বর্ষণ আর ঢলের পানিতে ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ-সিলেট সড়কের একপাশ ভেঙে গেছে। শনিবার সকালে ছাতক উপজেলার ‍সুফিনগর এলাকায়

সুনামগঞ্জে ১৬ জুন থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এখন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নদীর পানি কমছে। তবে পানি ধীরে কমায় মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। চার দিন পর আজ সকালে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। তবে এখনো জেলায় অসংখ্য বাড়িঘর, রাস্তাঘাটে পানি আছে। প্রায় ২৫ হাজার পরিবার আছে আশ্রয়কেন্দ্রে।

জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় বন্যায় ১ হাজার ১৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দী হয়ে পড়ে প্রায় ৮ লাখ মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেয় প্রায় ২৫ হাজার পরিবার। জেলা সদরের সঙ্গে কয়েকটি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

সুনামগঞ্জে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আরও উন্নতি হবে। পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে। সব উপজেলায় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।