বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ৫ আগস্ট বিকেলে ঢাকার সাভার উপজেলার বাইপাইলে গুলিতে নিহত হন আল আমীন (২৯) নামের এক যুবক। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় ৯ অক্টোবর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ১৫৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন আল আমীনের বাবা ইসমাইল। মামলাটি করতে ইসমাইলকে সহায়তা করেন তাঁর নিজ জেলা শরীয়তপুরের কয়েকজন বিএনপি নেতা। এখন দেখা যাচ্ছে, মামলায় এমন ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে, যাঁরা খোলা চোখে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। মামলায় এত আসামি কোথা থেকে এসেছেন, সেটিও জানেন না বাদী। ফলে তিনি মামলাটি সংশোধন করতে চাচ্ছেন।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বিঝারী ইউনিয়নের দক্ষিণ মগর গ্রামের ইসমাইল ও জিয়াসমিন বেগম দম্পতির ছেলে আল আমীন। তিনি সৌদি আরবে থাকতেন। চার মাস আগে দেশে ফিরে সাভারের বাইপাইল এলাকায় বাবার সঙ্গে মুদিদোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মিছিলে যোগ দিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। এরপর আর তাঁর কোনো সন্ধান পাচ্ছিল না পরিবার। ১৭ আগস্ট শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে তাঁর লাশ খুঁজে পান পরিবারের সদস্যরা। এরপর তাঁর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আল আমীনের বাবা ইসমাইলের করা মামলায় যে ১৫৪ জনকে আসামি করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, সাবেক সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন নাছিম, বি এম মোজাম্মেল হক, অপু উকিল প্রমুখ। এ ছাড়া শরীয়তপুরের বিভিন্ন পৌরসভার সাবেক মেয়র, কাউন্সিলর, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের আসামি করা হয়েছে। মামলায় আরও আসামি করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আব্দুস সালাম, আবুল কালাম খান, শরীয়তপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ তালুকদার, অসুস্থ চিকিৎসক মডার্ন হারবালের প্রতিষ্ঠাতা আলমগীর মতি, জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক আশরাফুল হক, নড়িয়া উপজেলা সহকারী সমবায় কর্মকর্তা শাহাদত হোসেনকে। মামলার ১৫৪ জন আসামির নামের মধ্যে অন্তত ১৫ জন ব্যবসায়ীর নামও আছে।
মামলার পর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক দিলরুবা আফরোজ ২১ অক্টোবরের মধ্যে আল আমীনের মৃত্যুর ঘটনায় কোনো সাধারণ ডায়েরি, কোনো অপমৃত্যু মামলা ও কোনো নিয়মিত মামলা হয়েছে কি না বা ওই ঘটনা পুলিশ তদন্ত করছে কি না, তা জানাতে ঢাকার কাফরুল থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
বাদী ইসমাইলের দাবি, এই মামলার পেছনে আছেন নড়িয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি দাদন মুন্সি ও একটি হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বাবুল তালুকদার। বাবুল শরীয়তপুর জজ কোর্টের সাবেক সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হাবীবুর রহমান ও তাঁর ভাই মনির হোসেন মুন্সিকে হত্যার মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়ে এখন পলাতক আছেন। আল আমীন হত্যা মামলায় তাঁর যোগসাজশে আসামির তালিকায় নাম এসেছে হাবীবুর রহমানের ছেলে পারভেজ রহমান, মেজবাউর রহমান ও মনির হোসেনের ছেলে বোরহান মুন্সির। এ ছাড়া দুই ভাই হত্যা মামলার খালাসপ্রাপ্ত কয়েকজন আসামিকেও আল আমীন হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। মামলায় যাঁদের সাক্ষী করা হয়েছে, তাঁরা বাবুল তালুকদার ও তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
মামলার বাদী ইসমাইল প্রথম আলোক বলেন, ‘বিএনপির কয়েকজন নেতা ও শরীয়তপুর শহরের একটি হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামি আমার সঙ্গে মামলার বিষয়ে যোগাযোগ করেছেন। তাঁরা আমাকে সহযোগিতা করার কথা বলে ডেকেছিলেন। বলেছেন এক রকম, আর কাজ করেছেন তার উল্টো। আমি বুঝতেও পারিনি আমাকে ব্যবহার করে এভাবে বিভিন্ন মানুষের নাম মামলায় দেওয়া হবে। মামলাটি করার জন্য উকিলের মাধ্যমে আমার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। ওই স্বাক্ষর দিয়ে এখন আমি ফেঁসে গেছি। আমি আইনগতভাবেই মামলাটি সংশোধন করার চেষ্টা করছি।’
মামলার আসামি হিসেবে নাম এসেছে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আব্দুস সালামের। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। ঘটনার সময় আমি দেশেই ছিলাম না। শত্রুতাবশত আমাকে আসামি করা হয়েছে। এখন ওই চক্রটি মামলা থেকে আমার নাম বাদ দেওয়ার জন্য আমার স্বজনদের কাছে টাকা চাইছে।’
শরীয়তপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার পতনের পর একটি চক্র আমার বাড়িতে হামলা চালায়। ওই চক্রটিই ষড়যন্ত্র করে একটি মামলায় আমাকে ফাঁসানোর জন্য আসামি করেছে।’
মডার্ন হারবালের প্রতিষ্ঠাতা চিকিৎসক আলমগীর মতি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকেন। তাঁর একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের স্যার অসুস্থ। তিনি হাঁটাচলা করার সময় অন্যের সহযোগিতা নেন। এমন একজন মানুষকে হত্যা মামলায় আসামি করায় আমরা হতভম্ব হয়ে গেছি।’
মামলার বাদী বাবুল তালুকদার নামের যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তিনি বর্তমানে যাবজ্জীবন দণ্ড নিয়ে পলাতক আছেন। সে কারণে ছাত্র হত্যার মামলায় আসামির তালিকা নিয়ে বাদী বিভ্রান্ত করার অভিযোগের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নড়িয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি দাদন মুন্সি ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। তিনি আজ রোববার সকালে হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে বলেন, আল আমীনের বাবা মামলা করার সহযোগিতা চেয়ে তাঁকে ফোন করেছিলেন। এরপর আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। কারা মামলায় আসামি হয়েছেন তা–ও তিনি জানেন না বলে দাবি করেন।
গতকাল শনিবার সকালে আল আমীনদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মা জিয়াসমিন ও বোন আফলান সিনথিয়া কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। একটি টিনের ঘরে মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে থাকেন জিয়াসমিন। সাংবাদিক এসেছেন খবর পেয়ে বসতঘরে আসেন। বলেন, ছেলে মারা গেছে আড়াই মাস হয়েছে। তার জন্য হাহাকার করছেন। এর মধ্যে মামলার যন্ত্রণা ও উৎপাতে পড়েছেন। এভাবে মামলাটি তাঁরা চালাতে চান না।