জাতের নাম ‘হেকিম ধান’। শুধু মুখে মুখে নয়, সাইনবোর্ড-ব্যানারেও লেখা ‘হেকিম ধান’। সাধুপাড়া গ্রামের কৃষক আবদুল হেকিম এ জাতের ধান বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাছাই করে কৃষকদের চাষ করতে দিয়েছেন। তাই গ্রামের কৃষকেরা ধানের জাতের নাম দিয়েছে ‘হেকিম ধান’।
ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার সাধুপাড়া গ্রামে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ছিল এই হেকিম ধান কাটার ঘোষিত দিন। দিনটি ঘিরে উৎসবে মেতেছিলেন গ্রামের কৃষকেরা। ধান কাটা ঘিরে কৃষকদের সমিতির ঘরে সকাল ১০টায় শুরু হয় সমিতির সভা। এরপর ‘হেকিম ধান’ কাটা এবং ধান কাটার পর আবারও সমিতির ঘরে ফিরে গিয়ে মিষ্টিমুখ করা হয় গ্রামের কৃষকদের। জাতটির ফলন আমন মৌসুমের অন্যান্য জাতের চেয়ে দ্বিগুণ। এ কারণে চার বছর ধরে সাধুপাড়া ও আশপাশের চারটি গ্রামের মানুষ আবদুল হেকিমের বাছাইকৃত এ জাতের ধান চাষ করেন।
আবদুল হেকিম ‘সাধুপাড়া কৃষক সংগঠন’ নামের কৃষক সমিতির সভাপতি। ধান কাটার এ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, আনুমানিক ১৫ বছর আগে তাঁর চাচাতো ভাই প্রয়াত কৃষক আবদুল জব্বার নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলায় বেড়াতে গিয়ে দেখতে পান, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে গ্রামে অন্তত ২০ জাতের ধানের চাষ করা হয়। তিনি সেখান থেকে ২০ জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করেন। পরের বছর থেকেই সাধুপাড়া গ্রামে ওই সব জাতের চাষ শুরু করেন। কিন্তু কয়েক বছর পর মারা যান আবদুল জব্বার।
এরপর ২০১৫ সালে আবদুল হেকিম নিজের জমিতে ওই ২০ জাতের ধানের পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করেন। প্রথম বছর ২০টি জাতের মধ্যে ৮টি জাত ভালো ফলন দেয়। পরের বছর ওই আট জাতের ধান পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেন। খরা উপেক্ষা করে সেবার যে জাতের ধান ভালো ফলন দেয়, সে জাতের ধান শুকিয়ে বীজ তৈরি করেন। পাঁচ বছর ধরে বাছাই ও বীজ সংগ্রহের কাজ করতে গিয়ে আবদুল হেকিম ধানের জাতের নাম ভুলে যান। তবে পরের বছর নিজের জমিতে ওই জাতের ধানের চাষ শুরু করেন। প্রথম বছরই ব্যাপক ফলন হওয়ায় গ্রামের অন্য কৃষকদের নজর কাড়ে। এরপরের বছর থেকেই সাধুপাড়া গ্রামের অন্য কৃষকেরা আবদুল হেকিমের কাছ থেকে ওই জাতের বীজ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। এভাবেই তারাকান্দা উপজেলার সাধুপাড়া, বিসকা, তারাটি, বাট্টাসহ আশপাশের কয়েক গ্রামে এ ধানের আবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এভাবেই কৃষকদের মুখে মুখে ‘হেকিম ধান’ নামকরণ হয়।
ধান কাটার এ উৎসবে উপস্থিত ছিলেন তারাকান্দার নওগুয়া গ্রামের কৃষক আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, দুই বছর ধরে তিনি হেকিম ধানের আবাদ করছেন। আমন মৌসুমের অন্যান্য জাতের ধানের চেয়ে হেকিম ধানের ফলন দ্বিগুণ। সাধুপাড়া গ্রামের কৃষক আমিনুল ইসলাম বলেন, ১০ শতাংশ জমিতে অন্যান্য জাতের ধানের ফলন হয় সবোর্চ্চ সাড়ে তিন মণ। হেকিম ধানের ফসল হয়েছে সাত মণ।
আবদুল হেকিম গ্রামের কৃষকদের উৎসাহে ধানের জাত নিয়ে গবেষণাও করছেন। কালিজিরা ও মুক্তা ইরি ধানের মধ্যে ক্রস করে তিনি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। ছয় বছর ধরে এ কাজ শুরু করেন। আগামী বছর সেটি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেবেন। এ বিষয়ে তিনি নেত্রকোনা জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজেনাস নলেজ (বারসিক) নামের একটি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখনো নিয়মিত ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
কৃষকদের ধান কাটার উৎসবে উপস্থিত ছিলেন বারসিকের এলাকা সমন্বয়ক ওহিদুর রহমান। তিনি বলেন, আবদুল হেকিম একজন মেধাবী কৃষক। তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাঁর পাশে থাকেন।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তারাকান্দা উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু সাঈদ তালুকদার। তিনি বলেন, আবদুল হেকিমের বাছাই করা হেকিম ধানের অধিক উৎপাদনের বিষয়টি তাঁরা জানেন। গ্রামের কৃষকদের এ ধানের আবাদ করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিষয়টি গবেষণার পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করবেন তাঁরা।