প্রয়াত সংগীতশিল্পী পাগল হাসানের স্মরণসভায় অতিথিরা। শনিবার রাতে সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির হাসন রাজা মিলনায়তনে
প্রয়াত সংগীতশিল্পী পাগল হাসানের স্মরণসভায় অতিথিরা। শনিবার রাতে সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির হাসন রাজা মিলনায়তনে

গানে ও কথায় অকালপ্রয়াত সংগীতশিল্পী পাগল হাসানকে স্মরণ

সুনামগঞ্জের প্রয়াত গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী মতিউর হাসান ওরফে পাগল হাসানের ‘পরম দুঃখের জীবন’ ও তাঁর সাধনাকে প্রেরণা হিসেবে নিতে চান তরুণ সংস্কৃতিকর্মীরা। গতকাল শনিবার রাতে ‘পাগল হাসান’ স্মরণ অনুষ্ঠানে এমনটাই বলেন তাঁর বন্ধু, স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির হাসন রাজা মিলনায়তনে ‘সুনামগঞ্জ কালচারাল ফোরাম’ এই স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘সাদা কালোই প্রথম আলো’। আয়োজকেরা জানান, পাগল হাসান গত ১৮ এপ্রিল ভোরে জেলার ছাতক শহরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এর কয়েক ঘণ্টা আগে ফেসবুকে নিজের সাদাকালো একটা ছবি দিয়ে তাতে লিখেছিলেন কথাটি। এটিই ফেসবুকে তাঁর শেষ পোস্ট ছিল।

আয়োজক সংগঠনের সভাপতি হাসানের বন্ধু তরুণ সংগীতশিল্পী সোহেল রানার সভাপতিত্বে স্মরণ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক রিপন চন্দ। অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন সুনামগঞ্জ পৌর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. শেরগুল আহমেদ, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সহসভাপতি প্রদীপ পাল, জেলা সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী, সদর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ চন্দ, থিয়েটার সুনামগঞ্জের সভাপতি দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী, সুনামগঞ্জ প্রসেনিয়াম থিয়েটারের সভাপতি দেবাশীষ তালুকদার।

স্মরণসভায় বক্তারা বলেন, হাসান সহজ কথায় গান লিখতেন। সেই গানের কথা অগুনতি মানুষের মনের কথা হয়ে প্রকাশ পেত। তাঁর গানের ভাব ও দর্শনে প্রেম, আধ্যাত্মিকতার অনবদ্য প্রকাশ ছিল। অল্প বয়সে তাঁর যে অর্জন, সেটি অনন্য ও অসাধারণ।

বক্তারা আরও বলেন, হাসান ছোটবেলায় বাবাকে হারান। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন হাসান। মনের দুঃখ না মিটলেও একটু বৈষয়িক সুখ যখন উঁকি দিচ্ছিল, ঠিক তখন পথেই থেমে গেল তাঁর ‘ভাব জীবনের রেলগাড়ির ইঞ্জিন’।

বক্তব্যের পর হাসানের জনপ্রিয় গান পরিবেশন করেন তরুণ সংগীতশিল্পী সোহেল রানা, মোহন রায়, আতাব রহমান, রিপন চন্দ, রাত্রি তালুকদার, উব্বাইয়া নাবিল, অনুপম প্রতীক, আফসার সায়েন, কানু চন্দ, সুষেন চন্দ প্রমুখ।

পাগল হাসান এক হাজারের ওপর গান লিখেছেন। তাঁর জনপ্রিয় কয়েকটি গান হলো—‘আসমানে যাইওনারে বন্ধু ধরতে পারব না/ পাতালে যাইওনারে বন্ধু ছুঁইতে পারব না’; ‘জীবন খাতায় প্রেম কলঙ্কের দাগ দাগাইয়া/ ছাড়িয়া যাইওনারে বন্ধু মায়া লাগাইয়া’; ‘মানুষ মইরা গেলে কদর বাইড়া যায়/ বাঁইচা থাকতে নিকৃষ্ট কয়/ মরলে শ্রেষ্ঠ পদক পায়’; ‘দুই দিনের সংসারি আর মিছা দুনিয়াদারি/ তোর চরণে দিলাম বিকাইয়া’; ‘কইরো ঘৃণা যায় আসে না/ তবেই যাবে মনের তাপ/ আল্লাহর ওয়াস্তে কইরা দিয়ো মাপ’; ‘জানতাম যদি তোমার পিরিত কচুপাতার পানি/ তবে কি আর কুল হারাইয়া হইতাম অপমানিরে বন্ধু’; ‘দেহ কুপির তেল ফুড়াইবে/ জ্বলবে না রে বাতি/ অনন্তকাল একলা রইবে/হইবে না কেউ সাথি’; ‘নদীর বুকে চান্দে খেলায়/ জলের বুকে মিন/ পাগল হাসানের বুকেতে দুঃখ সীমাহীন’; ‘ভব যাতনার ডাব্বা লইয়া ঘুইরা বেড়াই নিশিদিন/ জীবন আমার রেলগাড়ির ইঞ্জিন’; ‘ও পাখিরে, কে দিল রে তোর পায়ে শিকল/ তোর মনে কি দুঃখ নাইরে/ নাই নয়নে জল।’

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার শিমুলতলা গ্রামে পাগল হাসানের বাড়ি। তাঁর বাবা দিলশাদ মিয়া যখন মারা যান, তখন হাসানের বয়স পাঁচ বছর। মা আমেনা বেগমই তাঁকে অনেক কষ্টে বড় করেন। দোচালা দুই কক্ষের টিনের বেড়া ও টিনের চালার ঘরে মা, স্ত্রী, দুই ছেলে আর ছোট বোনকে নিয়ে থাকতেন পাগল হাসান। এখনো ভাঙা ঘরই আছে। সুনামগঞ্জ শহরে চাকরি করার সময় বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীত প্রশিক্ষক দেবদাস চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। একপর্যায়ে তিনি দেবদাস চৌধুরীর কাছে গানের তালিম নিতে শুরু করেন। সেই থেকে গানই তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। মাকসুদুর রহমান (১৫) ও মুশফিকুর রহমান (১৪) নামে তাঁর দুই ছেলে আছে।