দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সিলেটে চিনি চোরাচালানের সিন্ডিকেটে হাতবদল হয়েছে। এখন যুবদল ও ছাত্রদলের নেতারা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে এ সিন্ডিকেটের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাদের হাতে।
চোরাকারবারিদের দেওয়া তথ্যমতে, ক্ষমতার পালাবদলের পর ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। এ সুযোগে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেন যুবদল-ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের নেতৃত্বেই এখন সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাই চিনি ট্রাকে করে এনে নিরাপদে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হচ্ছে। এর বিনিময়ে যুবদল ও ছাত্রদলের নেতারা মোটা অঙ্কের টাকা নিচ্ছেন।
সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার চিনি আসে। এসব চিনি তামাবিল-জৈন্তাপুর-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ভোলাগঞ্জ-কোম্পানীগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে নগরের পাইকারি বাজার কালীঘাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। আগে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁদের অনুসারীরা পাহারা দিয়ে প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত চোরাই চিনির ট্রাক শহরে ঢোকাতেন। এখন এ কাজে হাতবদল ঘটেছে।
একাধিক চোরাকারবারির ভাষ্য, ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর কারবারিরা অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। চোরাচালানের হোতা ছাত্রলীগ নেতারাও আত্মগোপনে চলে যান। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকায় নজরদারিও আগের চেয়ে বাড়ে। এতে পাচার অনেকটা কমে যায়। তবে আবার চিনি পাচার শুরু হয়েছে। এখন শহরে নির্বিঘ্নে চোরাই চিনির প্রবেশ ঘটাতে যুবদল ও ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মী পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। এ ছাড়া জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর, সিলেট নগরের শাহপরান ও আম্বরখানা এবং দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বাইপাস এলাকায় ট্রাক আটকে যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে অনেকে চাঁদা আদায় করছেন।
এ ব্যাপারে সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি জেলায় নতুন যোগ দিয়েছি। এখন থেকে যে বা যাঁরা চোরাচালানে জড়িত থাকবেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যে দলেরই হোক না কেন, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’
গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে দক্ষিণ সুরমার বাইপাস এলাকায় দেখা গেছে, কয়েকজন যুবক ট্রাক আটকে ভেতরের মালামাল পরখ করছেন। কিছু ট্রাকের চালকদের কাছ থেকে তাঁরা টাকা আদায় করছেন। আবার কিছু ট্রাকের ভেতর পরখ করে ছেড়ে দিচ্ছেন।
বাইপাস এলাকার দুজন বাসিন্দা বলেন, যেসব ট্রাকে চিনির বস্তা পাওয়া যাচ্ছে, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। আর যেসব ট্রাকে চিনি নেই, সেসব ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা টাকা আদায় করছেন, তাঁরা নিজেদের যুবদল ও ছাত্রদলের কর্মী বলে পরিচয় দিচ্ছেন। তবে তাঁরা যুবদল কিংবা ছাত্রদলের কোন নেতাদের অনুসারী, সেটা জানা যায়নি।
এ বিষয়ে সিলেটের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার মো. জোবায়েদুর রহমান বলেন, চোরাই চিনি জব্দে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। যাঁদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আসছে, তাঁদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। ভবিষ্যতেও নেবে।
একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধ্যরাত থেকে ভোরের মধ্যে দুটি আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে ট্রাক ও পিকআপে চোরাই চিনি সিলেটে ঢোকে। গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও জৈন্তাপুর সীমান্তের চিনি তামাবিল-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট (একাংশ) সীমান্তের চিনি ভোলাগঞ্জ-কোম্পানীগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে সিলেটে আসে। এসব মহাসড়ক দিয়ে চিনি এখন ট্রাকপ্রতি ৫ থেকে ৮ হাজার টাকায় পার করিয়ে দিচ্ছে যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের কয়েকটি সিন্ডিকেট।
একই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট শহরে ঢোকার পর অধিকাংশ চিনি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রাকে করে যায়। এসব ট্রাক দক্ষিণ সুরমার বাইপাস এলাকাসহ কিছু স্থানে আটকিয়ে যুবদল ও ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মী আরেক দফা ট্রাকপ্রতি চাঁদা আদায় করে থাকেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশের অনুপস্থিতির সুযোগে এ চাঁদাবাজি এখন অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে পড়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কড়া নির্দেশনা রয়েছে। বিএনপি কিংবা অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে যে বা যারা অপকর্ম অথবা অপরাধ করবে, তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব, যুবদল কিংবা ছাত্রদলের কারও বিরুদ্ধে চিনি চোরাচালানে জড়িত থাকার সম্পৃক্ততা পেলে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া পুলিশকেও অনুরোধ করব, এমন অভিযোগ পেলে যেন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’