বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ রায়হান হোসেনকে (২৬) নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁর পরিবার। চিকিৎসা, সুস্থ হওয়া ও তাঁর কাজে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে না পেরে বাড়িতে যন্ত্রণা নিয়ে কাতরাচ্ছেন তিনি।
রায়হান হোসেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার যোগীপাড়া গ্রামের কৃষক খয়বর হোসেনের ছেলে। তাঁরা তিন ভাই-বোন। ৫ আগস্ট তিনি ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হন।
গত মঙ্গলবার বিকেলে রায়হান আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি কাতরাচ্ছিলেন। পাশে হতাশা আর উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন মা–বাবা। সন্তান সুস্থ হতে পারবে কি না, এ নিয়ে চিন্তিত তাঁরা। মা রাশেদা বেগমের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল।
সেদিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন রায়হান হোসেন। আন্দোলনে সফলতার কোনো আনন্দ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। চোখের সামনে নবম শ্রেণির এক ছাত্রের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলেই শিউরে উঠছেন তিনি।
সেদিনের রোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে রায়হান হোসেন বলেন, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ৫ আগস্ট ঢাকার রাজপথে ছাত্র-জনতার ঢল নামে। টেলিভিশনে শেখ হাসিনার পদত্যাগ করার খবর পেয়ে আনন্দে তিনিও ছাত্র-জনতার সঙ্গে মিশে গাজীপুর এলাকায় উল্লাস করছিলেন। দুপুরের পর তিনি অন্যদের সঙ্গে আশুলিয়া থানার সামনে গেলে সেখানে ৩৫ থেকে ৪০ জন পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র হাতে দেখতে পান। তাঁরা সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র উঁচিয়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন। ছাত্র-জনতা তাঁদের কাছাকাছি গেলে পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র নামিয়ে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। পাশে ভবনের ছাদ থেকেও ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা গুলি শুরু করেন। এ সময় শিশুসহ বেশ হতাহতের ঘটনা ঘটে। তিনিও দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। এই গুলিগুলো পাশের ভবনের ছাদ থেকে পুলিশ, ছাত্রলীগ-যুবলীগের লোকজন করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
রায়হান আহত অবস্থায় পাশে গুলিবিদ্ধ নবম শ্রেণির আরেক শিশুকে কাতরাতে দেখেন। শিশুটি তাকে উদ্ধারের জন্য বারবার আকুতি জানাচ্ছিল। তবে তাকে উদ্ধার করতে পারেননি তিনি। চোখের সামনে ছটফট করতে করতে শিশুর মৃত্যু হয় বলে জানান রায়হান।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাঁকেসহ গুলিবিদ্ধ অন্যদের পাশের গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান বলে জানান রায়হান। তিনি বলেন, সেখানে রোগীর অতিরিক্ত চাপ থাকার কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেও ভালো চিকিৎসা পাননি তিনি। এক দিন পর পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। সেখানে তিন দিন চিকিৎসার পর বাড়িতে চলে আসেন চিকিৎসকের পরামর্শে। এখন বাড়িতেই অবস্থান করছেন।
রায়হান জানান, চার বছর আগে তিনি স্ত্রীসহ গাজীপুরে পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। সেখানে একটি কলেজে ভর্তি হয়ে লেখাপড়ার করছিলেন। পরে পোশাক কারখানার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেখানে একটি ইপিজেডে চাকরি নেন। চাকরি করা অবস্থায় এই ঘটনা ঘটে। কবে তিনি সুস্থ হয়ে চাকরিতে ফিরতে পারবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। পায়ের মাংস পচে গেছে। তাঁর উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। উন্নত চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য তাঁর পরিবারের নেই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ২৫ থেকে ২৬ দিন হয়তো তিনি ছুটিতে থাকতে পারবেন। এই সময়ের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে চাকরি হারাবেন। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
রায়হানের বাবা কৃষক খয়বর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেটা চাকরি করায় তিনি চিন্তামুক্ত ছিলেন। সংসারের অভাব কিছুটা দূর হচ্ছিল। তিনি ছেলের সুচিকিৎসার ব্যবস্থার দাবি জানান।