চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনে একটি দোকান ভঙচুর করা হয়। আজ বেলা ১২টায় তোলা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনে একটি দোকান ভঙচুর করা হয়। আজ বেলা ১২টায় তোলা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

দোকানের দখল নিতে যুবলীগের হামলা, দফায় দফায় সংঘর্ষ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশনে একটি খাবার দোকান দখল নেওয়া নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আজ সোমবার ভোররাত থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হামলাকারীরা স্থানীয় যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অপর দিকে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন।

ঘটনাস্থলে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ, তাঁর ভাই ইকবাল হোসেনের অনুসারীরা অস্ত্র নিয়ে রাতের আঁধারে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে হামলাকারীদের শনাক্ত করে বিচার না করা হলে তাঁরা কঠোর আন্দোলনে যাবেন।

স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন–সংলগ্ন কয়েকটি দোকানের নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় যুবলীগ নেতা হানিফের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই দোকানগুলো রেলওয়ের জায়গায়। এ জায়গায় যাঁরা দোকান করতেন, তাঁরা হানিফকে নিয়মিত চাঁদা দিতেন। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মোহাম্মদ হানিফ এলাকা ছাড়েন। তবে দোকানের নিয়ন্ত্রণ ছাড়েননি। সরকার পতনের পর তাঁর নিয়ন্ত্রিত একটি জায়গায় নতুন করে খাবারের দোকান দেন চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার শিক্ষার্থী শেখ মাহদি হাসান। দুই মাস ধরে দোকানের মেরামত ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করছিলেন তিনি। আগামী দুই দিনের মধ্যেই ‘আপ্যায়ন’ নামের এই খাবার হোটেল চালু হওয়ার কথা ছিল। তবে হানিফের অনুসারীরা এতে বাধা দেন। দোকান পরিচালনা করতে হলে চাঁদা দিতে হবে বলেও দাবি করেন। এ নিয়ে গত শুক্রবারও দোকানটিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব নিয়ে বিবাদের মধ্যে আজ ভোররাতে এই দোকানটিতে ভাঙচুর করা হয়। এ সময় কয়েকটি পটকা ও কয়েকটি গুলি ছোড়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

গুলি ছোড়ার এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা জিরো পয়েন্টে জড়ো হন। পরে সেখানে সকাল সাতটার দিকে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের একজন মাইকিং করে জানান যে স্থানীয় লোকজনের ওপর জামায়াত–শিবিরের লোকজন হামলা করেছে। তিনি সবাইকে প্রতিহত করার অনুরোধ জানান। পরে স্থানীয় লোকজনও লাঠিসোঁটা নিয়ে সড়কে অবস্থান নেন। চার জায়গায় ব্যারিকেড দিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর নয়টার দিকে পুনরায় বাস চলাচল স্বাভাবিক হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে সামনে রেখে শিক্ষার্থীদের মিছিল। আজ সোমবার সকালে

জানতে চাইলে আপ্যায়ন দোকানের অন্যতম কর্ণধার ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থী শেখ মাহদি জানান, তাঁরা চারজন মিলে দুই মাস আগে এই দোকান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইতিমধ্যে তাঁদের ১২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। স্থানীয় যুবলীগ নেতা হানিফকে চাঁদা না দেওয়ায় তাঁদের দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। শিক্ষার্থীসহ তাঁদের দিকেও কয়েকটি গুলি ছোড়া হয়েছে। তবে যারা গুলি করেছে, তাদের মাথায় হেলমেট থাকায় কাউকে চিনতে পারেননি বলে দাবি করেন শেখ মাহদি।

এদিকে হামলার এ ঘটনায় চার শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, হানিফ ও তাঁর দলবল ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় আশ্রয় দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় তাঁরা অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হানিফ ও তাঁর সহযোগীদের গ্রেপ্তার না করা হলে তাঁরা কঠোর আন্দোলনে যাবেন।

এদিকে বক্তব্য জানতে চেয়ে মোহাম্মদ হানিফ ও ইকবাল হোসেনের মুঠোফোনে একাধিক কল করা হলেও তাঁরা কেউ রিসিভ করেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, একটি দোকানে রাতে হানিফের দলবল হামলা করেছে। ব্যাপক বোমাবাজি করেছে। ছাত্ররা এ ঘটনা বোঝেনি। তাঁরা বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট দিয়ে সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে জানিয়ে সবাইকে জিরো পয়েন্টে আসার অনুরোধ করেছে। শিক্ষার্থীদের জমায়েত দেখে হানিফ বাহিনীও স্থানীয় লোকজনের ওপর হামলা হচ্ছে বলে মাইকিং করেছে। এ কারণে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সকাল সোয়া আটটা পর্যন্ত তাঁরা পুলিশের সহযোগিতা পাননি।

মাইকিং করে লোক জড়ো

এদিকে আজ ভোররাত থেকেই স্থানীয় বাসিন্দারা মাইকিং করে জানাতে থাকেন জামায়াত–শিবিরের লোকজন তাঁদের ওপর হামলা করেছে। পরে স্থানীয় লোকজনও লাঠিসোঁটা নিয়ে সড়কে অবস্থান নেন।

জানতে চাইলে অন্তত তিনজন স্থানীয় বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীরা লুটপাটের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা নয়। কিন্তু আজকের ঘটনায় খামার থেকে গরু নেওয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় লুটপাট হয়েছে। এর আগেও জামায়াত–শিবির এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছে। আজকের ঘটনায় দেখে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন এটি জামায়াত–শিবিরের হামলা।

আজ সকাল ১০টায় সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টসংলগ্ন ছয়টি বড় গরু ও দুটি বাছুর বাঁধা রয়েছে। এখানে উপস্থিত কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, এ গরুগুলো তাঁরা মোহাম্মদ হানিফের খামার থেকে এনেছেন। দোকান ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলে তাঁরা গরুগুলো ফেরত দেবেন।

স্থানীয় লোকজনের এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি নাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ঢাকায় রয়েছেন। এ কারণে ঘটনার বিস্তারিত জানেন না।

স্থানীয় হানিফ দলবল নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে তিনি শুনেছেন।

তবে এ ঘটনায় ছাত্রশিবিরের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন সংগঠনটির সেক্রেটারি মুহাম্মদ ইব্রাহিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বিগত দু–তিন দিন জিরো পয়েন্টের কয়েকটা দোকানে লুটপাট হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রাতেও লুটপাট হয়েছে। স্থানীয় যুবলীগ নেতা হানিফের দলবল এসব ঘটিয়েছে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ ঘটনা তিনি পুলিশকে জানিয়েছিলেন। পুলিশ প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নিলে এমন হতো না।