চুয়াডাঙ্গায় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের এই জেলার ওপর দিয়ে টানা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। এপ্রিলের শেষ দিনে আজ মঙ্গলবার বেলা তিনটায় পৌর এলাকার হাটকালুগঞ্জের প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা চুয়াডাঙ্গার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। একই সময়ে বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১২ শতাংশ।
আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চুয়াডাঙ্গায় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে। সেই থেকে ৪০ বছরের ইতিহাসে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালের ২১ মে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এরপর গতকাল সোমবার ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়।
জামিনুর রহমান আরও বলেন, চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। এটি আরও এক দিন থাকতে পারে। এরপর তাপপ্রবাহ কমতে শুরু করবে। আগামী ৫ মে ভোরে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। ৬-৭ মে থেকে তাপপ্রবাহ থাকবে না।
আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্র জানায়, চলতি এপ্রিলের ৩০ দিনের মধ্যে অন্তত ১৩ দিনই চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত পাঁচ দিন অতি তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল। ২০০২ সাল থেকে চুয়াডাঙ্গায় বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে ২০০২ সালে ৪০ দশমিক ২ (২০ মে), ২০০৩ সালে ৪০ দশমিক ৮ (২৮ মে), ২০০৪ সালে ৪২ দশমিক ৪ (১৩ মে), ২০০৫ সালে ৪৩ (২ জুন), ২০০৬ সালে ৩৯ দশমিক ২ (৩০ এপ্রিল), ২০০৭ সালে ৩৯ দশমিক ৫ (৩১ মে), ২০০৮ সালে ৪০ দশমিক ৩ (২২ এপ্রিল), ২০০৯ সালে ৪১ দশমিক ৮ (২৭ এপ্রিল), ২০১০ সালে ৪১ দশমিক ৫ (১০ এপ্রিল), ২০১১ সালে ৩৮ দশমিক ৪ (১০ জুন), ২০১২ সালে ৪২ দশমিক ৯ (৪ জুন), ২০১৩ সালে ৪১ দশমিক ৫ (৯ এপ্রিল), ২০১৪ সালে ৪৩ দশমিক ২ (২১ মে), ২০১৫ সালে ৩৯ দশমিক ৮ (২২ মে), ২০১৬ সালে ৩৯ দশমিক ২ (১১ ও ২২ এপ্রিল), ২০১৭ সালে ৩৮ দশমিক ৫ (৩ এপ্রিল), ২০১৮ সালে ৩৯ দশমিক ৭ (১৮ জুন), ২০১৯ সালে ৩৯ দশমিক ৪ (২৮ এপ্রিল), ২০২০ সালে ৩৯ দশমিক ২ (৭ এপ্রিল), ২০২১ সালে ৪০ দশমিক ৫ (২৫ এপ্রিল) ও ২০২২ সালে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২৪ ও ২৫ এপ্রিল)।
চলমান তাপপ্রবাহের কারণে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ তেমন একটা ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। স্থানীয় হাটবাজারে তাপপ্রবাহের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। শহরের বিপণিবিতান ও বাজার ঘুরে দোকানদার ও কর্মচারীদের শুয়েবসে সময় কাটাতে দেখা গেছে। শহরের পুরোনো গলির বাজারে বেশ কয়েকটি কাপড়ের দোকানে দোকানিদের অলস সময় কাটাতে ও কর্মচারীদের মুঠোফোনে সময় কাটাতে দেখা যায়।
শহরের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা সমবায় নিউমার্কেটেও একই চিত্র চোখে পড়ে। একটি ছিট কাপড়ের দোকানের মালিক নাজমুল হক বলেন, তাপপ্রবাহের কারণে দিনের বেলা ক্রেতাদের উপস্থিতি অনেক কমে গেছে। শম্পা ফ্যাশন ওয়্যারের স্বত্বাধিকারী খন্দকার শামীম বলেন, তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ঈদের পর থেকে তেমন বেচাকেনা নেই। গরমের মধ্যে ক্রেতার জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অলস সময় কাটাতে হচ্ছে।
এদিকে ১০০ শয্যার চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে আজও ৪০০ জনের কাছাকাছি রোগী ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আতাউর রহমান মুন্সী প্রথম আলোকে বলেন, অতি তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। গুরুতর অসুস্থ রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চুয়াডাঙ্গাবাসী অতীতে কখনো এমন সংকটকালীন পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি। তাই সবাইকে স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনে চলতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। ঢিলেঢালা পোশাক ও ছাতা মাথায় দিয়ে বের হতে হবে। ভাজা-পোড়া ও সব ধরনের কোমল পানীয় থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রচুর পানি খেতে হবে।
অতি তীব্র তাপপ্রবাহে খেতের ধান নিয়ে উভয়সংকটে পড়েছেন চাষিরা। অন্তত ২০ জন কৃষক জানান, যাঁদের ধান কাঁচা-থোড় পর্যায়ে, তাঁরা বৃষ্টি চাইছেন। আবার যেসব জমির ধান ৮০ শতাংশের ওপর পেকে গেছে, তাঁরা আপাতত বৃষ্টি চাইছেন না। ওই ধান দ্রুত কেটে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কৃষি বিভাগ।
আজ দুপুরে সদর উপজেলার হাজরাহাটি মাঠে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন শ্রমিক ধান কেটে একটি লাটাহাম্বারে (স্থানীয়ভাবে তৈরি মিনি ট্রাক) ভর্তি করছেন। পাশেই ক্লান্ত একদল শ্রমিক খেজুরগাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছেন।
কর্মরত শ্রমিকদের একজন রতন আলী বলেন, ‘কষ্ট কল্লি কেষ্ট মেলে। রোদির ঠ্যালায় শরীলডা পুড়ে যাচ্চে। তারপরও দুটো পয়সার জন্নি পরিশ্রম কচ্চি। তবে ভয় কচ্চে ককন আবার জ্বরটর শুরু হয়ে যায়।’
সরকার অতি তীব্র তাপপ্রবাহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করলেও শহরতলির দৌলাতদিয়াড় এলাকার ফজলুল উলুম ক্যাডেট স্কিম মাদ্রাসায় পাঠদান ও পরীক্ষা নিতে দেখা গেছে। এ ছাড়া পাড়া-মহল্লায় কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীদের যেতে দেখা গেছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) কবির হোসেন বলেন, অভিভাবকদের এ বিষয়ে আন্তরিক হতে হবে। তাঁদের সচেতন করতে উদ্যোগ প্রয়োজন।