ভোট চুরি হয়নি, লজ্জাজনকভাবে ফলাফল চুরি হয়েছে

হিরো আলম
ফাইল ছবি

বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে আলোচিত প্রার্থী ছিলেন আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বগুড়া-৪ আসনে ৮৩৪ ভোটে ভোটে হেরেছেন তিনি। তবে জামানত হারাতে যাচ্ছেন বগুড়া-৬ আসনে। বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনের ফলাফল কারচুপি করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন হিরো আলম। ন্যায়বিচার পেতে উচ্চ আদালতেও যাওয়ার কথা বলছেন তিনি। নির্বাচনের সার্বিক বিষয় নিয়ে ভোটের পরদিন প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন হিরো আলম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বগুড়ার নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার পারভেজ।

প্রশ্ন

দুই আসনে একতারা প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। ভোটারদের কেমন সাড়া পেলেন? একটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও সদরে তো জামানত হারালেন।

হিরো আলম: শুরু থেকে দুই আসনেই ভোটের মাঠ চাঙা ছিল। কিন্তু বগুড়া-৬ আসনে ভোট শুরুর পর চিত্র পাল্টে যায়। অনেক কেন্দ্র দখল করা হয়। আমার নির্বাচনী এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়, মারধর করা হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তাকে অভিযোগ করেও প্রতিকার মেলেনি। সার্বিক পরিস্থিতিতে বগুড়া সদরে জয়ের আশা বাদ দিতে হয়েছে। সেখানে পরিকল্পিতভাবে আমাকে হারিয়ে দেওয়ায় জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তবে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে সুষ্ঠুভাবে ভোট হয়েছে। বিজয়ও সুনিশ্চিত ছিল। কিন্তু কারচুপির মাধ্যমে সেখানে ফলাফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন

নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগ এনেছেন। কিসের ভিত্তিতে এ অভিযোগ? কী তথ্য–প্রমাণ আছে?

হিরো আলম: এ আসনে ভোট চুরি হয়নি, লজ্জাজনকভাবে ফলাফল চুরি হয়েছে। ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেন্দ্রে গিয়ে আমাকে বিপুল ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত কর্মকর্তারা আমার মতো অশিক্ষিত মূর্খ ছেলেকে 'স্যার' ডাকতে হবে, এতে তাঁদের মানসম্মান থাকবে না, শুধু এই কারণে মুহূর্তের মধ্যে ফলাফল পাল্টে দিয়েছেন। কেন্দ্রের ফলাফল নির্বাচনী এজেন্টদের কাছে সরবরাহ করার কথা থাকলেও বেশ কিছু কেন্দ্রে আমার এজেন্টদের কাছে ফলাফল সরবরাহ করা হয়নি। আবার নন্দীগ্রাম উপজেলায় স্থাপিত নির্বাচন কমিশনের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ফলাফল ঘোষণার সময় ৪৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১ থেকে ৩৯টি কেন্দ্রের ফলাফল কেন্দ্রভিত্তিক ঘোষণা করা হয়। একতারার বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর হঠাৎ ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রাখা হয়। কিছু সময় চুপচাপ থাকার পর ১০ কেন্দ্রের ফল কেন্দ্রভিত্তিক ঘোষণা না করে হঠাৎ জাসদের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনের মশাল প্রতীকে বেশি ভোট দেখিয়ে বিজয়ী করা হয়। ১০ কেন্দ্রের ফলাফল কেন্দ্রভিত্তিক ঘোষণার কারণ কী? একটি কেন্দ্রে মশাল প্রতীকে ভোট পড়েছে ২৮, অথচ গণনার সময় বেশি ভোট দেখানো হয়েছে। আরেকটি কেন্দ্রে একতারায় ৩০৭ ভোট পড়েছে, গণনার সময় ৭ ভোট দেখানো হয়েছে। নির্বাচনী এজেন্টদের ডেকেছি। সব তথ্য–প্রমাণ নিয়ে হাইকোর্টে রিট করব। ফলাফল পাল্টিয়ে আমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, সেটা দেশবাসীর কাছে প্রমাণ করেই ছাড়ব।

প্রশ্ন

দুই আসনের সব কেন্দ্রে একতারার এজেন্ট ছিল না। নির্বাচনী সমন্বয়ক, এমনকি তেমন সক্রিয় কর্মীও দেখা যায়নি। নির্বাচনী প্রস্তুতি এত ঘাটতি ছিল কেন?

হিরো আলম: বগুড়া-৪ আসনে ১১২ কেন্দ্রের সব কটিতেই একতারা প্রতীকের এজেন্ট ছিল। তাঁরা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। ভোট গ্রহণ শেষে কেন্দ্র থেকে তাঁরা নিজ উদ্যোগে নির্বাচনী ফল সংগ্রহ করেছেন। এই ফলাফলে একতারা অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু কোনো কোনো কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের ফলাফল শিট সরবরাহ করা হয়নি। নির্বাচনী প্রধান সমন্বয়ক আমি নিজেই ছিলাম। সাধারণ ভোটাররাই আমার সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তাঁরা কেন্দ্রে কেন্দ্রে সার্বিক পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করেছেন।

প্রশ্ন

বগুড়া-৬ (সদর) আসনে তো কেন্দ্রে কেন্দ্রে একতারা প্রতীকের এজেন্ট দেখা যায়নি।

হিরো আলম: বগুড়া-৬ আসনে অনেক কেন্দ্র থেকে আমার নির্বাচনী এজেন্টকে নৌকার কর্মীরা বের করে দিয়েছেন। হামলা ও মারধর করা হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ভোটকক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম। গতকাল সকালে বগুড়া সদরের এরুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে
প্রশ্ন

বগুড়া-৪ আসনে ফলাফল ছিনতাই হয়েছে দাবি করছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন?

হিরো আলম: এই আসনে নৌকা-ধানের শীষের প্রার্থী ছিল না। নির্বাচন নিয়ে শুরুতে ভোটারের আগ্রহও কম ছিল। শুধু আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসার কারণেই উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটাররা কেন্দ্রে এসে দলমত-নির্বিশেষে সবাই একতারা প্রতীকে ভোট দিয়েছেন। সেখানে মশাল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল না। অথচ হঠাৎ ফল পাল্টিয়ে মশাল পাস দেখানো হলো। একতারার বিজয় ছিনতাই হয়েছে। এই ফলাফল ভোটাররা মানতে পারছেন না, এ কারণে প্রত্যাখ্যান করেছি। ফলাফল বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করার প্রস্তুতি নিয়েছি। আর রিটার্নিং কর্মকর্তাকে অভিযোগ করে লাভ কী? বগুড়া সদরে ভোটের অনিয়ম বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেও লাভ হয়নি, ফলাফল বাতিল চেয়েও লাভ হবে না, অযোগ্য নির্বাচন কমিশন। উচ্চ আদালতই একমাত্র ভরসা।

প্রশ্ন

ফলাফল পাল্টানোর কারণ কী?

হিরো আলম: কিছু শিক্ষিত সমাজের লোক আছেন, যাঁরা কিনা আমাকে মেনে নিতে চান না। তাঁরা মনে করেন, আমি সংসদ সদস্য হলে বাংলাদেশের সম্মান থাকবে না, তাঁদের সম্মান যাবে। তথাকথিত এই শিক্ষিতরা মনে করেন, অশিক্ষিত, মূর্খকে ‘স্যার’ বলে ডাকতে হবে। এতেই তাঁদের আপত্তি। তাঁরা আমাকে মেনে নিতে চান না, শুধু এ কারণেই নির্বাচনী ফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন

কিন্তু বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তো সংসদে যেতে আপনার বাধা নেই।

হিরো আলম: নির্বাচন কমিশন যে অযোগ্য, সেটা আরও একবার জাতির সামনে প্রমাণ হয়ে গেল। এই প্রহসনের নির্বাচন করার কী দরকার ছিল? সরকারের পছন্দমতো প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করলে কী হতো? জনগণের ট্যাক্সের টাকা খরচ করে নির্বাচনের নামে এই নাটক করার কী দরকার ছিল? শুরু থেকেই আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। আমার জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই দুই দফা মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। শেষে হাইকোর্টে রিট করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছিলাম। সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করতে শুরু থেকেই কেন্দ্রে সিসিটিভি স্থাপনের দাবি করেছিলাম। প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করতে কেন্দ্রে সিসিটিভি স্থাপন করা হয়নি। আবার একটি আসনে ভোট সুষ্ঠু হলেও আমাকে মেনে নিতে না পেরে ফলাফল পাল্টানো হলো। নির্বাচনের নামে এ রকম প্রহসন হলে, ভোটব্যবস্থা নির্বাসনে যাবে। ভোটের কথা, গণতন্ত্রের কথা মানুষ ভুলে যাবে। তথাকথিত শিক্ষিতদের জন্য দেশটা রসাতলে যাবে।

প্রশ্ন

ফলাফল বাতিলের জন্য আইনি লড়াই করবেন। কর্মী-সমর্থকেরা কী বলছেন?

হিরো আলম: বগুড়া-৪ আসনের আসনের ভোটাররা কোনোভাবেই এ ফলাফল মেনে নিতে পারছেন না। কারণ, সিংহভাগ কেন্দ্রেই শুধু হিরো আলমকে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটাররা কেন্দ্রে গেছেন। ভোটার ও সমর্থকেরা এ ফলাফল মেনে নিতে পারছেন না। ভোটারদের অধিকার ফিরিয়ে দিতেই ফলাফল বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।