শাহানারা বেগম জানেন না তাঁর পরিবারের আট সদস্য কে কোথায় আছেন। তিনি ও ছেলের বউ—দুজনকে কোনোরকমে উদ্ধার করে ফেনী সদরের ফাজিলপুর স্টেশনে রেখে গেছেন স্থানীয় লোকজন। দুই দিন ধরে তাঁদের দিন কাটছে স্টেশনে। শুধু গতকাল শনিবার দুপুরে মুড়ি ও চিড়া পেটে গেছে।
ষাটোর্ধ্ব শাহানারা বেগমের সঙ্গে কথা হয় গতকাল বেলা একটায়। ফাজিলপুর রেলস্টেশনে তিনি ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে বসে ছিলেন। মহাসড়ক থেকে ৪০ মিনিট নৌকায় চড়ে রেলস্টেশনে পৌঁছানোর পর দেখা যায়, অর্ধশতাধিক বন্যাকবলিত মানুষ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেই মেঝেতে বসে ছিলেন শাহানারা বেগম।
কথায় কথায় শাহানারা বেগম জানালেন, তাঁর বাড়ি ফাজিলপুর ইউনিয়নের এক প্রান্তে। তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি ছাড়াও বাড়িতে ছেলেদের বউ ও নাতি-নাতনি মিলিয়ে ৯ জন।
নুরুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ঘরটা মজবুত নয়। পানির যে স্রোত তিনি দেখেছেন, তাতে ধারণা করেন, ঘর পড়ে যাবে।
শাহানারা বেগমের ভাষ্য, বুধবার রাতেই তাঁদের একচালা ঘর ডুবে যায়। বিদ্যুৎও চলে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেলের বউ ও তিনি পাশের একটি একতলা বাসার ছাদে গিয়ে দাঁড়ান। বাকিরা নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর জন্য পানির মধ্যে হাঁটা দেন। রাতটা আতঙ্কের মধ্যে সেখানেই কাটিয়েছেন। পরে ভোরের আলো ফোটার পর তাঁদের দুজনকে উদ্ধার করে রেলস্টেশনে রেখে যান স্থানীয় লোকজন।
শাহানারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতের বেলা পানি বাড়তে থাকে। দূর থেকে কিছু প্রতিবেশীর গলার আওয়াজ শুনছিলাম। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। রাত যত গভীর হয়েছে, আতঙ্কও বেড়েছে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেছিল।’
শাহানারা বেগম জানান, তাঁর ছেলেরা কে কোথায় আছেন, সে খবর গতকাল দুপুর পর্যন্ত পাননি। তাঁর কাছে কোনো মুঠোফোন নেই। কারও নম্বরও নেই। কেউ তাঁদের খুঁজতে আসেনি।
রাতের বেলা পানি বাড়তে থাকে। দূর থেকে কিছু প্রতিবেশীর গলার আওয়াজ শুনছিলাম। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। রাত যত গভীর হয়েছে, আতঙ্কও বেড়েছে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেছিল।শাহানারা বেগম
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে বিছানা পেতে বসে ছিলেন বীথি রানি দাস (৩০)। একপাশে খেলছিল তাঁর ছেলে, পেছনে ঘুমাচ্ছিলেন শাশুড়ি। বীথি জানান, দাসপাড়ায় ছোট একটা ঘর ছিল তাঁদের। ছিল হাঁস-মুরগি। বানের পানি সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তাঁরা গত বুধবার সন্ধ্যায় উঠেছেন প্ল্যাটফর্মে। তাঁর স্বামী খাবারের জন্য এদিক-ওদিক ছুটছেন। কিন্তু পাচ্ছেন না।
বন্দনা রানি দাসের (৩৫) বাড়িও দাসপাড়ায়। তিনি আশ্রয় নিয়েছেন চার দিন হলো। ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে তিনিও অন্য সবার মতো বিপদে আছেন। বন্দনা বলেন, ঘর থেকে এক কাপড়ে বের হয়েছেন তাঁরা। তাঁর স্বামী তরুণ দাস পানি হাতড়ে গিয়ে মুড়ি এনেছিলেন। সেই মুড়ি খেয়েছে সন্তানেরা।
‘আমরা এখন কী করব, কোথায় ঠাঁই হবে’
প্ল্যাটফর্মের এক কোনায় চালের বস্তা বিছিয়ে শুয়ে ছিলেন নুরুন নাহার। বয়স তাঁর সত্তরের কাছাকাছি। ভেজা শরীর নিয়ে গুটিসুটি দিয়ে শুয়ে থাকা এ বয়োজ্যেষ্ঠ নারী বলেন, তাঁর জীবদ্দশায় কখনো এত ভয়াবহ বন্যা দেখেননি। পাঁচ দিন ধরে বন্যা তাঁর ঘুম কেড়ে নিয়েছে। শরীর অত্যন্ত দুর্বল, ক্লান্ত। মনে হচ্ছে প্রাণ বেরিয়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে।
এসব কথা বলেই আকাশের দিকে তাকান নুরুন নাহার। বলেন, ‘এ কোন পরীক্ষায় ফেললে আল্লাহ। আমরা এখন কী করব, কোথায় ঠাঁই হবে। ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।’
কথা বলে জানা গেল, নুরুন নাহারের স্বামী দুই বছর আগে যক্ষ্মায় মারা গেছেন। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়েছে বছর সাতেক আগেই। একমাত্র ছেলের সঙ্গে বাড়িতে থাকতেন। টিন আর বেড়া দিয়ে কোনোরকমে ঘরটা টিকে ছিল। এখন সেটি অক্ষত থাকবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা।
ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী—এ ছয় উপজেলা পুরোপুরি বন্যাকবলিত।
নুরুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ঘরটা মজবুত নয়। পানির যে স্রোত তিনি দেখেছেন, তাতে ধারণা করেন, ঘর পড়ে যাবে।
নুরুন নাহারের ছেলে আসগর মিয়া বিয়ে করেছেন বছর পাঁচেক আগে। ঘরে এক মেয়ে। তিনি মুদিদোকানে কাজ করে যা আয় করেন, তা দিয়ে সংসার চলে। অভাব যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এখন আবার ঘর তোলার সুযোগ নেই। তারপরও সবার যে গতি, তাঁরও একই।
ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী—এ ছয় উপজেলা পুরোপুরি বন্যাকবলিত। গ্রামের পর গ্রাম ডুবে আছে। বাড়িঘরে কোনো জনমানব নেই। কারও ঠিকানা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউ আত্মীয়ের বাসায় মাথা গুঁজেছেন। আবার বন্যাকবলিত কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে স্থানীয় স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও মন্দিরের ভবনে উঠেছেন। সুপেয় পানি ও খাবারের সংকট আরও প্রকট হয়েছে।