নানান গাছ, বাঁশঝাড়, বেতের ঝোপ বাড়িটিকে ঘিরে আছে। দুই দিকে বিস্তীর্ণ খোলা ধানের মাঠ। হু হু করা বাতাস এসে গাছে গাছে আছড়ে পড়ছে। দুলে উঠছে গাছের শাখা–প্রশাখা। শ্রীনাথপুরের এই বাড়িতে যিনি থাকেন, বইয়ের সঙ্গে তাঁর এক জীবনের প্রেম। বাড়ির বসার ঘরে সেলফের পর সেলফে থরে থরে সাজানো বই। দেশি-বিদেশি উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণাগ্রন্থ, সাহিত্য ও সাময়িকী—কী নেই ব্যক্তিগত এই সংগ্রহশালায়।
বাড়িতে ঢুকতেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন লুঙ্গি ও শার্ট পরা ছোটখাটো একজন মানুষ। মাথায় চেনা ক্যাপ। তিনি লোকগবেষক ও সংগঠক আহমদ সিরাজ (৬৫)। কমলগঞ্জ সরকারি গণ মহাবিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর জীবনে নেই অবসর। আছে কেবলই নদীর মতো ছুটে চলা।
কোথায় বাঁশ-বেতশিল্প গড়ে উঠছে, মধু চাষ হচ্ছে, মৃৎশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে, তাঁতশিল্পে প্রাণ জাগছে—এসব বিষয়ের খোঁজ পেলেই ছুটে যান আহমদ সিরাজ। সবার নজরে আনেন তাঁদের সমস্যা ও সম্ভাবনা। বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যে মাটিসংলগ্ন সংস্কৃতির খোঁজ পেয়েছেন; মানুষের যেসব বঞ্চনা, দুঃখকষ্ট তাঁকে পীড়িত করেছে, ঘুরে ঘুরে তা–ই কাছ থেকে দেখেছেন ও লেখায় তুলে ধরেছেন। এসব লেখা নিয়ে বেরিয়েছে তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধের ৯টি বই।
আহমদ সিরাজের অনুরাগীও রয়েছেন অনেক। তাঁদের একজন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) উপপরিচালক কবি ও প্রাবন্ধিক স্বপন নাথ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আহমদ সিরাজ একাধারে চারণ লেখক, দার্শনিক, সমাজকর্মী ও সংগঠক। প্রথাগত সীমাবদ্ধতার জালে আটকা পড়েননি তিনি। প্রত্যন্ত গ্রামে গড়ে তুলেছেন জ্ঞান সাধনার আশ্রম। পুরোনো দলিলাদিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বই ও পত্রিকা রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। বিষয়েও আছে বৈচিত্র্য। তরুণ বয়সে সমাজ নিয়ে কাজ শুরু করেন, এখনো ছুটে চলেছেন সেই লক্ষ্যে। নিজের গড়া বইয়ের রাজ্যেই তাঁর বসবাস ও লেখালেখি। জীবন নিবেদিত করেছেন মানুষের মুক্তিসংগ্রামে। তাঁর এমন নিমগ্ন সাধনা আমাদের অনুপ্রাণিত করে।’
আহমদ সিরাজ থাকেন শ্রীনাথপুরে। এটি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে। মানুষের জীবনের চিন্তা ও কাজের সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর অপার কৌতূহল। চার হাজারের মতো বই সংগ্রহে রয়েছে জানিয়ে আহমদ সিরাজ বলেন, ‘৩০ বছরের বেশি সময় ধরে আমি বই কিনছি। যখনই শহরে গিয়েছি, অন্য নানা খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে পছন্দের বই কিনেছি। এখন সব সময় এটাই করি।’
নিজের বই প্রেমের পেছনে অনেক গুণী ব্যক্তির ভূমিকা রয়েছে জানিয়ে আহমদ সিরাজ বলেন, ‘তাঁরা সবাই ছিলেন জ্ঞানের অন্বেষক। তাঁদের মধ্যে আছেন প্রাবন্ধিক রসময় মোহান্ত, রাজনীতিক মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মফিজ আলী, লেখক সীতারাম বর্মণ প্রমুখ। তাঁরা সবাই ছিলেন বয়সে আমার অনেক বড়। কিন্তু বই এই বয়োজ্যেষ্ঠতার দেয়ালকে দূরে ঠেলে আমাদের ঘনিষ্ঠ করে তুলেছিল। তাঁদের কাছ থেকে পেয়েছি পাঠের নতুন নতুন জানালা। বই কেনা ও পড়ার মধ্য দিয়েও যে আনন্দ অন্বেষণ করা যায়, তা তাঁদের কাছ থেকেই পাওয়া।’
তাঁর বইয়ের ভুবনে আসতেন প্রয়াত কবি দিলওয়ার। প্রায় নিয়মিত অতিথি ছিলেন এই কবি। এসেছেন প্রয়াত লোকগবেষক শামসুজ্জামান খান, প্রয়াত মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ, গবেষক সেলু বাসিত, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘ফসল’ সম্পাদক মো. আবদুল খালিক, কবি ও প্রাবন্ধিক স্বপন নাথ, কবি শোয়াইব জিবরানসহ নবীন-প্রবীণ অনেক লেখক। আসেন প্রশাসনের অনেক বইপ্রেমী কর্মকর্তা। স্ত্রী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার—যা বই ও কাজের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে।
কমলগঞ্জের মধুচাষি উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি আলতাফ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আহমদ সিরাজ একজন নিঃস্বার্থ সমাজসেবক ও সংগঠক। তাঁর মতো নিবেদিতপ্রাণ ও প্রচারবিমুখ মানুষ বিরল। কমলগঞ্জ উপজেলার মধুচাষি, বাঁশ, বেত, তাঁতশ্রমিকসহ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। দেশ-জাতির কল্যাণেই তাঁর কাজ।’
আহমদ সিরাজের সংগ্রহশালায় রয়েছে অনেক দুর্লভ বই। বিভিন্ন জায়গা থেকে দুষ্প্রাপ্য অনেক বই ফটোকপি করেও এনেছেন তিনি। অনেকে তাঁর সংগ্রহশালায় এসে গবেষণার কাজ করেন। আহমদ সিরাজ বলেন, ‘বই ছাড়া আমার এক দিনও চলে না। অনেকটা নেশার মতো। এখন অনেকেই শিক্ষিত হচ্ছে, সব বাড়িতেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস লোক রয়েছে। কিন্তু বই পড়োর লোকের বড় অভাব।’
ফেরার পথে নিজের স্বপ্নের কথাও জানালেন প্রবীণ এই সাধক। বলেন, বইয়ের এই সংগ্রহশালাকে বাড়াতে—যাতে তা আরও অনেক মানুষের কাজে আসতে পারে।