ছোট-বড় গম্বুজ তাকিয়ে আছে আকাশপানে। রোজার মধ্যে চৈত্রের দুপুরে খরতাপে যখন হাঁসফাঁস অবস্থা, গম্বুজ দেখে কাছে যেতেই ছায়া-সুশীতল পরিবেশের সান্নিধ্য পাওয়া গেল। বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা মসজিদ কমপ্লেক্সের সুবিশাল দ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই স্বস্তি দিল প্রকৃতি। সামনে বিশাল দিঘি, শানবাঁধানো প্রশস্ত ঘাট। নানা প্রজাতির ফুল-ফলদ বৃক্ষশোভিত চারদিকে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। মসজিদ ঘিরে গড়ে ওঠা স্থাপনার সৌন্দর্যে অপার্থিব অনুভূতি পাওয়া গেল।
মসজিদটির নাম বাইতুল আমান জামে মসজিদ। বরিশালের উজিরপুর হয়ে বানারীপাড়া যাওয়ার পথে সড়কের পাশে দৃষ্টিনন্দন এক মসজিদ। নান্দনিক স্থাপত্যের এ মসজিদ দেখতে প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী আসেন। সুদৃশ্য ক্যালিগ্রাফি, বর্ণিল কাচ ও মূল্যবান মার্বেল পাথরের নির্মাণশৈলীর অনন্য সৌন্দর্যের মসজিদটি দেখে প্রশান্তি পান দর্শনার্থীরা।
বুধবার দুপুরে মসজিদের সামনে দিঘির শানবাঁধানো ঘাটে বসে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা রাহাত হাওলাদার। বরিশালের এক বন্ধুকে নিয়ে তিনি মসজিদ দেখতে এসেছেন। রাহাত বলেন, ‘এত সুন্দর ও এত বড় মসজিদ আগে দেখিনি। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো সৌন্দর্য। শান্ত ও সুনিবিড় পরিবেশ। সবকিছুই পরিকল্পিতভাবে ও নান্দনিকতার মিশেলে করা হয়েছে। এখানে এসে খুবই ভালো লাগছে।’
গোলাপি, সাদা, ক্রিম ও হলুদ রঙের মসজিদটির সৌন্দর্য এককথায় অপূর্ব। মসজিদের সামনে ফিরোজা ও নীল রঙের টাইলস দিয়ে নির্মিত ফোয়ারা দুটি নান্দনিকতায় নতুন মাত্রা দিয়েছে। মসজিদের প্রবেশপথের সামনে, ভেতরে চার কোনার চার গম্বুজের নিচে ও উল্লেখযোগ্য স্থানে শোভা পাচ্ছে পবিত্র কোরআনের ক্যালিগ্রাফি। মাঝে কেন্দ্রীয় গম্বুজের চারপাশে বৃত্তাকারে সুরা আর রহমানের ক্যালিগ্রাফি। সুদৃশ্য দরজা, মূল্যবান ঝাড়বাতি, সিরামিকস, গ্লাস, মার্বেল ও গ্রানাইট পাথরে সজ্জিত মসজিদের ভেতরে গেলে যে কাউকে বিমোহিত করবে।
স্থানীয়ভাবে গুঠিয়া মসজিদ নামে পরিচিত এ মসজিদের নতুন নাম বাইতুল আমান জামে মসজিদ কমপ্লেক্স। ২০ গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি বরিশাল শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের চাংগুরিয়া গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটিতে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য আলাদা নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা আছে।
কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক মো. শামসুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা গুঠিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা ব্যবসায়ী এস সরফুদ্দিন আহমেদ (সান্টু)। বর্তমানে মসজিদে ২২ জন ও অন্যান্য কাজে ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। তাঁদের বেতন-ভাতা, বিদ্যুৎ বিল ও অন্যান্য রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি মাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয় হয়। প্রতিষ্ঠাতা নিজেই এসব ব্যয় বহন করেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থী মসজিদটি দেখতে আসেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দর্শনার্থী আরও বেড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন।
মূল মসজিদে ১ হাজার ৩৫০ ও বাইরে মিলিয়ে সাড়ে ৪ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। এ ছাড়া ঈদগাহে ৬ থেকে ৭ হাজার মুসল্লি ঈদের জামায়াতে শরিক হন। সংশ্লিষ্টরা জানান, মূল মসজিদ ও কমপ্লেক্সের কাজ শুরু হয় ২০০০ সালে। ২০০৬ সালে শেষ হয় নির্মাণকাজ। মালয়েশিয়াপ্রবাসী এস সরফুদ্দিন আহমেদ চাংগুরিয়ায় নিজ বাড়ির সামনে ১৪ একর জমির ওপর নিজ অর্থায়নে মসজিদ ও ঈদগাহ কমপ্লেক্স নির্মাণ করেন। নকশা করেছেন স্থপতি এম আমিনুল হক।
মসজিদটি মধ্যপ্রাচ্যের তিন-চারটি মসজিদের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে হুবহু নয়। প্রতিষ্ঠাতা সরফুদ্দিন আহমেদ তাঁর স্থপতি বন্ধুকে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ঘোরেন। সেই সব মসজিদের আদলে গুঠিয়া মসজিদটির নকশা করা হয়। মসজিদ কমপ্লেক্সের মূল প্রবেশপথের ডানে বড় পুকুর। পুকুরের পশ্চিমে মসজিদ। মসজিদ লাগোয়া মিনারটির উচ্চতা ১৯৩ ফুট। এ ছাড়া বিশাল ঈদগাহ ময়দান, কার্যালয়, খতিব ও মুয়াজ্জিনের বাসভবন, এতিমখানা, হাফিজিয়া মাদ্রাসা, কবরস্থান, ডাকবাংলো, হেলিপ্যাড ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে।
সুবিশাল পুকুরের চারপাশে বিভিন্ন ফুলের গাছ সৌন্দর্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। পুকুরপাড়ের রাস্তাগুলো পাকা। কাঠবাদামগাছের নিচে শানবাঁধানো ঘাট। ঘাটের ঠিক উল্টো দিকে মসজিদের প্রবেশপথে দুটি ফোয়ারা বসানো হয়েছে। রাতে আলোর ঝলকানিতে ফোয়ারাগুলো দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। মসজিদের সামনের পুকুরটি এমনভাবে খনন করা হয়েছে, যাতে পানিতে মসজিদের প্রতিবিম্ব দেখা যায়।
মসজিদ ঘুরে দেখা গেছে, ভেতরের চারপাশে ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে সুরা আর রহমান লেখা। ভেতরের চার কোণের চার গম্বুজের নিচে, প্রবেশ তোরণের সামনে ও ভেতরের কয়েকটি স্পটে আরও ক্যালিগ্রাফি শোভা পাচ্ছে। এসব ক্যালিগ্রাফি ও আলপনা বর্ণিল কাচ, মূল্যবান মার্বেল পাথর, গ্রানাইট ও সিরামিকস দিয়ে করা হয়েছে। ভেতরের নয়টি গম্বুজে বিশালাকৃতির নয়টি অত্যাধুনিক ও মূল্যবান ঝাড়বাতি বসানো হয়েছে। মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে সাদা মার্বেল পাথরের টাইলস।
মনামী রহমান নামের এক নারী মা-বাবাকে নিয়ে বগুড়া থেকে মসজিদ দেখতে এসেছেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, অনেক দিন ধরেই মসজিদটির নাম শুনছেন, ছবি-ভিডিও দেখেছেন। কয়েকবার প্রস্তুতি নিয়েও আসতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘এবার রোজায় ছুটি নিয়ে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। কী যে সুন্দর, কী যে মুগ্ধতা, বলে বোঝাতে পারব না। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে এত নান্দনিক স্থাপনা আছে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না।’
বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে বাস বা মাহিন্দ্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যেই গুঠিয়া মসজিদে যাওয়া যায়। নথুল্লাবাদ থেকে মসজিদ পর্যন্ত মাহিন্দ্রায় প্রতিজনের ভাড়া ৩০ টাকা। এ ছাড়া নথুল্লাবাদ থেকে বানারীপাড়া যাওয়ার যেকোনো বাসে উঠে মসজিদের সামনে নামা যায়। ১৫ মিনিট পরপর বাস ছাড়ে।