টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণের এখনই সময়

হাওরে প্রায় প্রতিদিনই পর্যটক থাকেন। তবে শুক্র ও শনিবার অন্য দিনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি থাকে
ছবি: প্রথম আলো

নানা বয়সী হাজারো মানুষ এখন নয়নাভিরাম টাঙ্গুয়ার হাওরে। নৌকা থেকে কিংবা টাওয়ার থেকে ঝাঁপ দিচ্ছেন হাওরের স্বচ্ছ জলে। সারি সারি করচগাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরছেন ছোট ছোট নৌকা নিয়ে। ছবি তুলছেন। উল্লাস করছেন তরুণ-তরুণীরা। দল বেঁধে নেমেছেন সাঁতার কাটতে। করচগাছের ছায়ায় নৌকায় বসে কেউ শুনছেন হাসন রাজার গান, কেউবা শাহ আবদুল করিমের গান।

শুক্রবার মধ্যদুপুরে হাওরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এলাকার দৃশ্য এমনটাই ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নৌকা, হাউসবোটের সংখ্যা বাড়তে থাকে। হাওরে প্রায় প্রতিদিনই পর্যটক থাকেন। তবে শুক্র ও শনিবার অন্য দিনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন তাঁরা। এই দুই দিন হাওরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও এর আশপাশের এলাকায় পরিবেশটাও পর্যটকে মুখর হয়ে ওঠে। নারী-পুরুষ-শিশু—সব বয়সী মানুষের উপস্থিতি থাকে।

টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে এসেছেন আকাশ দত্ত (২৬) ও তাঁর স্ত্রী মমতা মিত্র (২৩)। হাতে বাওয়া ছোট নৌকায় করে ঘুরছিলেন হাওরের করচগাছের বাগানের ভেতর। কথা বলে জানা গেল, আকাশের বাড়ি মাগুরায়। ঢাকার একটি হাসপাতালে চাকরি করেন। চাকরির সুবাদে ঢাকাতেই থাকেন। মমতা এখনো পড়াশোনা করেন। হাওরে এসেই হাউসবোট থেকে নেমে ছোট নৌকা নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছেন এই দম্পতি।

আকাশ দত্ত বলেন, সারা রাত বাসে ছিলেন, এরপর আরও এক ঘণ্টায় সুনামগঞ্জ থেকে এসেছেন তাহিরপুরে। সেখান থেকে এ জায়গায় বোটে আসতে সময় লেগেছে আরও প্রায় এক ঘণ্টা। কিন্তু এখানে এসে পথের সব ক্লান্তি শেষ। চমৎকার জায়গা। বিশাল জলরাশি, পাশেই মেঘালয়ের পাহাড়; মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। মমতা মিত্র বললেন, ‘পুরো এলাকাটিই ছবির মতো সুন্দর। না এলে মিস করতাম।’

গাজীপুর থেকে ১৬ আইনজীবী এসেছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। সবাই জলে নেমে সাঁতার কাটছেন। জলকেলিতে ব্যস্ত লাইফ জ্যাকেট পরে হাওরে নামা শিশুরাও। আইনজীবী নজরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘অনেক দিন ধরেই আসার কথা ভাবছিলাম, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। এবার সবাইকে নিয়ে এসেছি। বেশ ভালো লাগছে।’

পাখির চোখে দেখা সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওর

শামীমা নাসরিন ও সুলতান আহমেদ হাওরের করচবাগানের এক পাশে ছোট নৌকায় বসে শিশুদের গান শুনছিলেন। হাওরপাড়ের বিভিন্ন গ্রামের শিশুরা দল বেঁধে নৌকা নিয়ে ঘোরে আর পর্যটকদের গান শোনায়। এতে তাদের কিছু আয়–রোজগার হয়। এই দম্পতি ঢাকার বিশেষায়িত শিশুদের স্কুলের শিক্ষক। শামীমা নাসরিন বলছিলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওর আমার প্রিয় জায়গা। এখানে এলে অন্য রকম প্রশান্তি পাই। এর আগে একা কয়েকবার এসেছি। আজ স্বামীসহ এলাম। ওর বেশ পছন্দ হয়েছে। আবার আসব।’

সুনামগঞ্জ শহরের সুরমা নদীর ঘাট থেকে সরাসরি কিংবা তাহিরপুর উপজেলা সদরের ঘাট থেকে নৌকায়, হাউসবোটে করে টাঙ্গুয়ার হাওরে আসেন পর্যটকেরা। আবার নেত্রকোনা থেকেও কিছু নৌকা আসে পর্যটকদের নিয়ে। একসময় হাওরে রাত্রিযাপনের চল না থাকলেও এখন হাওরে নৌকায়, হাউসবোটে রাত যাপন করেন অনেকেই। নৌকায় খাওয়াদাওয়া, গানবাজনা—সবই হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত নৌকাগুলো পর্যটকদের নিয়ে অবস্থান করে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এলাকায়। এরপর এগুলো পর্যটকদের নিয়ে যায় হাওরের উত্তরপাড়ে, মেঘালয় পাহাড়ের কোলে টেকেরঘাটে। সেখানে প্রতিদিন শত শত নৌকায় রাত যাপন করেন পর্যটকেরা। সেখান থেকে পাশে শহীদ সিরাজ লেক (নিলাদ্রী), বারিকের টিলা, শিমুলবাগান আর জাদুকাটা নদের অপার সৌন্দর্য ঘুরে দেখেন তাঁরা।

হাওরের জলে সাঁতার কাটতে নেমেছেন অনেকে

তবে ওই স্থানে রাত যাপনের পরিবেশ নিয়ে পর্যটকদের অনেকেই নাখোশ। সুনামগঞ্জ শহর থেকে আসা মাহবুবুল হাছান নামের একজন বলেন, এখানে নৌকায় থাকা সবাই মলমূত্র ত্যাগ করেন। পানিতে পলিথিন, মরা মুরগিসহ নানা আবর্জনা ভাসছে। নানা রকম বর্জ্য ফেলা। দুর্গন্ধ আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এগুলোতে নজর দেওয়া দরকার।

টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকবাহী একটি নৌকার চালক খসরু আলম বলছিলেন, এ হাওরে নৌকায় ভ্রমণের সময় হলো চার মাস, জুন থেকে সেপ্টেম্বর। তখন হাওরে বেশি পানি থাকে, ঝড়-বৃষ্টি হলেও তা তীব্র হয় না। এরপর পানি কমতে থাকবে। তবে শুকনা মৌসুমে হাওরের আরেক রূপ আছে, এটিও অনেক পর্যটকদের টানে। তখন হাওরে অতিথি পাখি আসে।

বর্ষা ও শুকনা মৌসুমে টাঙ্গুয়ার হাওরের দুই রূপ চোখে পড়ে। বর্ষায় দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। এই জলরাশির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে হিজল ও করচগাছের বাগান। তখন হাওরের গ্রামগুলোকে মনে হয় ছোট ছোট দ্বীপ। যেন জলের ওপর ভাসছে। হাওরের উত্তরে সবুজে মোড়া মেঘালয় পাহাড়। নীল আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি। বিকেলের রোদে মেঘের ছায়া পড়ে নীল হয়ে ওঠে হাওরের জল। তখন পুরো এলাকাকে ছবির মতো মনে হয়।

হাউসবোট থেকে নেমে ছোট নৌকা নিয়ে ঘুরতে বের হন অনেকে

শুকনা মৌসুমে হাওরে জল থাকে কম। তখন হেঁটেই হিজল ও করচবাগানের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। ‘হাওরকন্যা’ সুনামগঞ্জের পরিচিতির মূলে আছে টাঙ্গুয়ার হাওর। এটি দেশের সবচেয়ে বড়, সুন্দর ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় জলাভূমি। সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে জেলার তাহিরপর ও ধরমপাশা উপজেলায় এ হাওরের অবস্থান। দুই উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ১৮টি মৌজা মিলে হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে ছোট-বড় ৫৪টি বিল আছে। এর ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন হাওর রূপ নেয় সমুদ্রে। হাওরের উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা ৩৮টি ঝরনাও মিশেছে এই টাঙ্গুয়ার হাওরে।