বাবার অসুস্থতা আর আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে এইচএসসির পর আর পড়াশোনা করতে পারেননি রবিন হোসেন (২৩)। পড়াশোনা ছেড়ে ঢাকার গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারের আনিকা এজেন্সি নামের একটি স্যানিটারি দোকানে চাকরি নেন। নিজের আয় দিয়েই সংসার আর বাবার চিকিৎসার খরচ দিতেন। এর মধ্যে মাস তিনেক আগে পাশের গ্রামের জিয়াসমিন আক্তারকে বিয়ে করেছিলেন। রবিনের ইচ্ছা ছিল, নতুন ঘর তুলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসবেন। কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হলো না তাঁর।
গত মঙ্গলবার বিকেলে সিদ্দিকবাজারের ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন রবিন। প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে রবিনের বাবা সোহরাব হোসেন আর মা তাসলিমা আক্তার পাগলপ্রায়। বিয়ের মাত্র তিন মাসের মধ্যেই স্বামীর এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না রবিনের স্ত্রী জিয়াসমিন আক্তার। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার পূর্ব নাগেরপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে রবিনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
গোসাইরহাট উপজেলার পূর্ব নাগেরপাড়া গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোহরাব হোসেন ও তাসলিমা আক্তার দম্পতির দুই ছেলে—সাহাদাৎ হোসেন ও রবিন হোসেন। বড় ছেলে সাহাদাৎ ১০ বছর আগে বিয়ে করে ঢাকায় আলাদা থাকেন। আর রবিন পড়াশোনা করতেন। বাবা সোহরাব ঢাকার একটি গাড়ির গ্যারেজে কাজ করতেন। তিনি স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে কেরানীগঞ্জের কদমতলী এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। তবে ২০২০ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে সোহরাব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর সংসারের দায়িত্ব আসে সোহরাবের কাঁধে। এইচএসসি পাস করার পর পড়াশোনা ছেড়ে দেন তিনি।
রবিনের স্বজনেরা বলেন, গ্রামের বাড়িতে রবিনের বাবার কোনো আবাদি জমি নেই। একমাত্র সম্বল বলতে আছে শুধু পাঁচ শতক জমির ওপর বসতভিটা। এর মধ্যে গত বছর ৮ ডিসেম্বর পাশের গ্রামের জিয়াসমিন আক্তারকে বিয়ে করেন রবিন। বাড়িতে নতুন ঘর তুলেই স্ত্রীকে বাড়িতে আনার কথা ছিল। মঙ্গলবার সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের পর রবিনের এক বন্ধু বিষয়টি তাঁর পরিবারকে জানায়। মঙ্গলবার সারা রাত ও পরদিন বুধবার সকাল থেকে তাঁর স্বজনেরা ঘটনাস্থলে রবিনের খোঁজে অপেক্ষা করেন। পরে বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে রবিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনুষ্ঠানিকতা শেষে গতকাল ভোরে তাঁর লাশ আসে গ্রামের বাড়িতে। এ সময় সেখানে শোকের ছায়া নেমে আসে।
রবিনের স্ত্রী জিয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকেলে সে (রবিন) আমাকে ফোন করেছিল। অনেক সময় ধরে কথা বলেছিলাম। আমি নামাজ পড়ব, সেই কারণে পরে ফোন ছেড়ে দিই। নামাজ শেষ করেই তো তার দোকানে দুর্ঘটনার খবর পাই। কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না। আর যখন খোঁজ পেলাম, তখন সব শেষ। স্বামীর বাড়িতে এভাবে বিধবা হয়ে আসতে হবে, তা কখনো ভাবতে পারিনি। এখন আমি বাকি জীবন কীভাবে কাটাব?’
ছেলের শোকে এখন দিশাহারা তাসলিমা আক্তার। তিনি বলেন, ‘রবিনকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না। অনেক কষ্ট করে সবাই মিলে ঢাকায় থাকতাম। ছেলেকে চোখের আড়াল করতাম না। আল্লাহ কেন আমার মানিককে চিরদিনের জন্য আড়াল করে দিলেন? স্বামী অসুস্থ হওয়ার পরে সংসারের চাপে ছেলেটি পড়ালেখা বন্ধ করে কাজ শুরু করেছে। আমরাও ছেলের আয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। এখন আমাদের কে দেখবে, অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা কীভাবে হবে, কিছুই বুঝতে পারছি না।’
রবিনের বাবা সোহরাব হোসেন বলেন, ‘বাড়িতে নতুন ঘর নির্মাণ করে রবিনের বউকে আনার কথা ছিল। নতুন বউকে এখনো আমাদের বাড়িতে আনতে পারিনি। রবিনের নিথর দেহ দেখার জন্য মেয়েটিকে আনা হলো। ওর চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। কী জাবাব দেব মেয়েটিকে? রবিনের মৃত্যু আমার পরিবারটিকে অসহায় করে দিয়েছে।’
গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাফী বিন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণে নাগেরপাড়া এলাকার রবিনের মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। তাঁর পরিবারের অসহায়ত্বের বিষয়টি সহানুভূতির জায়গা থেকে দেখা হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত রবিনের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকবে।