বিকাল হলেই দোকানের টেবিলের চারপাশে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। কেউ বলছেন, ‘আমাকে পাঁচটা পরোটা দিন’, কেউ বলছেন, ‘আমাকে শর্ষেভর্তা দিন।’ আবার কারও চাওয়া শুঁটকিভর্তা। ‘দিচ্ছি বাবা’ বলতে বলতে ক্রেতাদের সামনে দুই হাত আর মুখ চলছে হোসেনে আরা বেগমের। এসব বিক্রি করেই চলছে তাঁর আট সদস্যের সংসার।
দিনাজপুরের বিরামপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণে প্ল্যাটফর্মঘেঁষা হোসেনে আরা বেগমের আলুপরোটার দোকান। তাঁর বাড়ি পৌরসভার কাজীপাড়ায়। প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা কিংবা ১০ পর্যন্ত দোকানটি খোলা থাকে। আলুপরোটার দোকানটি বেশ পরিচিতি পেয়েছে। সেই সঙ্গে বিক্রিও বেশ ভালো। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এই দোকানে খেতে আসেন। আলুপরোটার পাশাপাশি হোসেনে আরা বেগম ক্রেতাদের প্লেটে তুলে দেন বাদাম, তিল, শর্ষে, কাঁচামরিচ, ধনিয়া, শসা ও শুঁকটির ভর্তা। দোকানের কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন তাঁর নাতি রাব্বি হোসেন। আর যখন দোকানে ক্রেতার ভিড় বেড়ে যায়। তখন রাব্বির মামা শাহাবুদ্দিন দোকানে এসে তাঁদের সহযোগিতা করেন।
প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ৭০০ থেকে ৮০০ আলুপরোটা বিক্রি করেন হোসেনে আরা বেগম। শুক্রবার বেশি পরিমাণে আলুপরোটা বিক্রি হয়। প্রতিটি আলুপরোটার দাম ১৫ টাকা। আয় বাড়াতে আলুপরোটার পাশাপাশি কয়েক মাস ধরে দোকানে পেঁয়াজু বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০টি পেঁয়াজু বিক্রি হয়। প্রতিটি পেঁয়াজুর দাম পাঁচ টাকা। এতে প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার টাকা বেশি বিক্রি হয়। আলুপরোটা বিক্রির আয়েই ছেলের বউ, দুই নাতি, নাতবউ, নাতিদের দুই ছেলেসহ আটজনের সংসার চলে।
হোসেনে আরা বেগম বলেন, আলুপরোটা তৈরি ও সুস্বাদু করতে আদা, রসুন, মসলা, টেস্টি লবণ ও জিরা ব্যবহার করেন তিনি। আলুপরোটা তৈরিতে প্রতিদিন আধা মণ আলু ও দেড়মণ আটা লাগে।
আলুপরোটার দোকানে কাজের ফাঁকে সম্প্রতি আলাপকালে ৭০ বছর বয়সী হোসেন আরা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী ইসরাইল হোসেন খুলনায় একটি জুটমিলে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইসিস) হয়ে তিনি মারা যান। এর পর থেকে ছেলে আনোয়ার হোসেনকে নিয়েই চলে তাঁর বেঁচে থাকার লড়াই। ছেলে বড় হলে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পান তিনি। তাঁর কাছ থেকে ছেলেও আলুপরোটা বানানো শিখেছেন।
প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ৭০০ থেকে ৮০০ আলুপরোটা বিক্রি করেন হোসেনে আরা বেগম। শুক্রবার বেশি পরিমাণে আলুপরোটা বিক্রি হয়। প্রতিটি আলুপরোটার দাম ১৫ টাকা।
প্রায় ১২ বছর আগে ছেলে আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে বিরামপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের উত্তর পাশে টেবিল বসিয়ে আলুপরোটা বিক্রি করেন হোসেনে আরা বেগম। পরে সেখানে ঝামেলা হওয়ায় পৌর শহরের বকুলতলা মোড় দোকানটি সরিয়ে নেন। সেখানে কয়েক বছর ভালোই চলছিল তাঁর দোকান। চার বছর আগে বিরামপুর রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের দক্ষিণে রেলওয়ের ছোট্ট একটি জায়গা ইজারা নেন। এর পর থেকে সেখানেই জমজমাট হয়েছে তাঁর আলুপরোটার ব্যবসা।
এই দোকানে আলুপরোটা খেতে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে এসেছেন টাকটপুর দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আলমগীর কবির। দোকানে বসার জায়গা না পেয়ে প্ল্যাটফর্মের রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আলুপরোটা খাচ্ছেন তিনি।
৩০ মে সন্ধ্যায় আলাপকালে আলমগীর কবির বলেন, সারা দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যস্ত থাকেন। সন্ধ্যায় স্ত্রী-সন্তানকে সময় দিতে তাঁদের নিয়ে স্টেশনে আলুপরোটা খেতে এসেছেন। এখানে বিভিন্ন ধরনের ভর্তা দিয়ে আলুপরোটা বিক্রি হয়। খেতে অনেক ভালো লাগে। এর আগেও এখানে বেশ কয়েকবার আলুপরোটা খেতে এসেছিলেন।
প্রতিদিন সকালে বাড়িতে তাঁর মেয়ে, দুই নাতবউ মিলে আলু, আটা ও বিভিন্ন ধরনের মসলা মেখে খামির তৈরি করেন। দুপুরে চার-পাঁচ প্রকারের ভর্তা তৈরি করেন। পরে বিকেলে দোকানে আলুপরোটা তৈরি করে বিক্রি করা হয়।হোসেনে আরা বেগম
হোসেনে আরা বেগম বলেন, প্রতিদিন সকালে বাড়িতে তাঁর মেয়ে, দুই নাতবউ মিলে আলু, আটা ও বিভিন্ন ধরনের মসলা মেখে খামির তৈরি করেন। দুপুরে চার-পাঁচ প্রকারের ভর্তা তৈরি করেন। পরে বিকেলে দোকানে আলুপরোটা তৈরি করে বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০টি পরোটা বিক্রি হয়। পরোটা বিক্রির আয় দিয়েই চলে তাঁর সংসারে আটজনের ভরণপোষণ।
বিরামপুর পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র আবদুল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, হোসেন আরা বেগমের দোকানে আলুপরোটা খেতে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন রেলস্টেশনে আসেন। এলাকায় তাঁর আলুপরোটার বেশ সুনাম রয়েছে। হোসেনে আরা বেগম যদি পৌরসভা থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা চান, তাহলে তাঁকে সহযোগিতা করা হবে।