সড়কের দুই পাশেই এখানে-সেখানে পাত্রে জ্বাল দেওয়া হচ্ছে আখের রস। বড়সড় পাত্রের প্রায় প্রতিটিতেই রসের মধ্যে উপুড় করে রাখা হয়েছে অপরিশোধিত চিনি–গুড়ভর্তি একটি টিন। আগুনের তাপে গলে গলে আখের রসে মিশে যাচ্ছে এগুলো। কিছুক্ষণ জ্বাল দেওয়ার পর টিনটি তুলে ফেললে সেখানে থেকে যাচ্ছে অপরিশোধিত চিনি–গুড়ের দলা। এভাবেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে তৈরি হচ্ছে ‘আখের রসের গুড়’।
উপজেলাটির নাককাটিতলা সড়কে একটু ঘোরাফেরা করলেই হামেশা এমন দৃশ্যের দেখা মেলে। সম্প্রতি এক সকালে সেখানে গেলে স্থানীয় লোকজন বলেন, বিভিন্ন স্থানে দুই সপ্তাহ ধরে আখের রস থেকে গুড় তৈরি শুরু হয়েছে। আখচাষিরা দাবি করেছেন, এ সময়ের আখের রসের গুড় ঠিকমতো জমাট বাঁধে না। গুড় জমাতেই তাঁরা অপরিশোধিত এসব চিনি–গুড় ব্যবহার করেন।
টিনভর্তি অপরিশোধিত এসব চিনি–গুড় ভারত থেকে আমদানি করা হয়—দাবি রস জ্বাল দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের। তাঁরা বলেন, দুই বছর ধরে গুড় তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এর আগে গুড় জমানোর জন্য এক পাত্র রসে পাঁচ কেজি চিনি দেওয়া হতো। এখন ভারতীয় এসব অপরিশোধিত চিনি–গুড়ের পুরো এক টিন দেওয়া হয়। প্রতিটি টিনে প্রায় ২২ কেজি উপকরণ থাকে।
আখচাষিদের একজন পিঠালীতলা গ্রামের মো. শাহ আলম। তিনি লাভের আশায় আখ কেটে জমিতে রসুন লাগিয়েছেন। ফলে আগাম তুলে ফেলা আখের রস দিয়েই তৈরি করতে হচ্ছে গুড়। আর সেখানে অপরিশোধিত চিনি–গুড় ব্যবহার করা হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও কৃষি উদ্যোক্তা মুনজের আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম বছর লাগানো আখ ন্যূনতম ১১ মাসের হলে গুড় উৎপাদন করা যায়। এই আখকে স্থানীয়ভাবে ‘দের আখ’ বলে। এর কাণ্ড থেকে জন্ম নেওয়া পরবর্তী বছরের (দ্বিতীয় ও তৃতীয়) আখগুলোকে ‘মুড়ি আখ’ বলা হয়। এসব আখগাছের ১০ মাস বয়স থেকে এর রস দিয়ে গুড় উৎপাদন করা হয়। আখ লাগানোর সময় হচ্ছে মূলত কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে অথবা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিকে।
আখের রসে অন্য কিছু মেশানো ঠিক নয় বলে মনে করেন মুনজের আলম। তিনি বলেন, এতে গুড়ের শুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যায়। আখের গুড়ের উপকারিতা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া ভারতীয় নিম্নমানের অপরিশোধিত চিনি–গুড়ে কী কী উপাদান আছে, কী ক্ষতি হচ্ছে,তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরীক্ষা করে দেখা দরকার। জেলায় মোট ৫ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়। এর মধ্যে শিবগঞ্জ উপজেলায় এবার ৪ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে আখের চাষ হয়েছে।
শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নয়ন মিয়া বলেন, ‘কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আগাম কেটে নেওয়া আখের রসে ভারত থেকে আনা অপরিশোধিত চিনি–গুড় মেশানো হচ্ছে। এগুলো সাদা ও লাল রঙের। এগুলো আমদানি করা হচ্ছে সোনামসজিদ বন্দর দিয়ে।’
বন্দরটি দিয়ে ভারত থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি ট্রাকে টিনভর্তি চিনি আমদানি করা হচ্ছে বলে জানান আমদানি পণ্য খালাস ও ভাড়া আদায়ে নিয়োজিত পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের সোনামসজিদ স্থলবন্দরের ব্যবস্থাপক মাইনুল ইসলাম।
চিনি হিসেবে আমদানি হলেও এগুলো অপরিশোধিত চিনি–গুড়, যা দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা আখের রসের গুড় বানান, এমনটাই লোকজনের ভাষ্য।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীন সোনামসজিদ বন্দরের সঙ্গনিরোধ উইংয়ের উপপরিচালক সমীর চন্দ্র ঘোষ বলেন, যেসব কৃষিপণ্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে আমদানি করা হয়, সেগুলোই পরীক্ষার আওতায় পড়ে। চিনির নামে কী আসছে, তা পরীক্ষা করা দরকার।
বাংলাদেশ সুগার ক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সামশুল আরেফিন বলেন, অপরিশোধিত এসব ভারতীয় চিনি–গুড়ের ক্ষতির দিকটি কেবল পরীক্ষার পরই বলা সম্ভব। ক্ষতিকর উপাদান আছে কি না, তা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা ছাড়া বলা সম্ভব নয়। তবে গুড় তৈরিতে আখের রসে অন্য কিছু মেশানো অবৈধ।