দিনভর অন্যের কেনা মাছ কেটে দেন মিনা সংকরী (৬৫)। ছোট-বড় সব ধরনের মাছই কাটেন তিনি। বিনিময়ে মাছের আকার ভেদে প্রত্যেকের কাছ থেকে মজুরি পান ২০ থেকে ৫০ টাকা। দিনে গড়ে আয় হয় ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। এর মধ্যে দিনে মাছ কাটার জায়গার ভাড়া ৮০, হাসিল ২৫, ঋণের কিস্তি ৩০০ ও চা-পান বাবদ ১০ থেকে ১৫ টাকা খরচ হয় তাঁর। বাকি টাকা দিয়ে তাঁর সংসার চলে না।
মিনা সংকরী প্রথম আলোকে বললেন, প্রতিদিন খরচ বাদে যে টাকা থাকে, তা দিয়ে দিন চলে না। কোনো মাসে অসুখ-বিসুখ হলে বিপদে পড়তে হয়। তিনি বলেন, ‘অন্যের মাছ কেটে দিই। কিন্তু নিজের ভাগ্যে মাছ জোটে না। শখ করেও বড় মাছ কিনে খেতে পারি না।’
গাইবান্ধা শহরের ঐতিহ্যবাহী পুরোনো বাজারে মাছ কাটার কাজ করেন মিনা সংকরী। তাঁর স্বামী প্রফুল্ল চন্দ্র বর্মণ পল্লিচিকিৎসক ছিলেন। স্বামীর বাড়ি ছিল সদর উপজেলার আনালেরতারি গ্রামে। কিন্তু মিনার কপালে স্বামী-সন্তানের সুখ বেশি দিন থাকেনি। তিন সন্তান রেখে স্বামী মারা যাওয়ার পর গাইবান্ধা শহরের ব্রিজ রোডের কালীবাড়ী এলাকায় মাসিক ৪৫০ টাকা ভাড়ায় একটি বাসায় ওঠেন।
শহরের পুরোনো বাজারের মাছ শেডে ঢুকলেই মিনা সংকরীর দেখা মিলবে। শনিবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, মাছ বিক্রেতাদের পাশে বসে আছেন আধপাকা চুলের এক নারী। পাশে চুলার ছাইয়ের ওপর রাখা কাঠের তৈরি একটি বঁটি। মনোযোগ দিয়ে মাছ কাটছেন তিনি। এভাবে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাছ কাটেন মিনা সংকরী।
মিনার সংকরীর এক মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়ে শিল্পী রানী বর্মণ স্বামীর বাড়িতে সংসার করছেন। বড় ছেলে পলাশ চন্দ্র বর্মণ (৪০) মানসিক ভারসাম্যহীন। ছোট ছেলে কাজল চন্দ্র বর্মণ (৩৫) অটোরিকশা চালান। বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। মিনার স্বামীর মৃত্যুর পর ছোটবেলায় বড় ছেলে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। তাঁর চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন মিনা। চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা ঋণ হয়েছে। এখনো তাঁর চিকিৎসা চলছে।
মিনা সংকরী প্রথম আলোকে বলেন, দৈনিক ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা আয় হয়। কোনো কোনো দিন আয় অর্ধেকও হয় না। ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক টাকা ঋণ হয়েছে। এখন ঋণের কিস্তি টানতে হচ্ছে। দৈনিক কিস্তি ৩০০ টাকা। তিনি বলেন, তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়ে গেছে। সে জন্য বিধবা বা বয়স্ক ভাতা পান না তিনি। মিনা বললেন, এখন মাছ কেটে দিন চলছে। কিন্তু যখন শরীর চলবে না, তখন কীভাবে দিন চলবে?
মিনার পাশে বসে মাছ বিক্রি করেন কৃষ্ণ চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, বাজারে কয়েকজন মাছ কেটে দেওয়ার কাজ করেন। এর মধ্যে একজনই নারী। এ জন্য ছোট মাছ কেটে নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে বেশি আসেন ক্রেতারা। অসহায় নারী বলে তাঁরাও তাঁকে সহযোগিতা করেন।
গাইবান্ধা সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন শাহ বলেন, ইউনিয়ন বা পৌরসভার মাধ্যমে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা দেওয়ার জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ে তালিকা পাঠানো হয়। সেই তালিকা পাওয়ার ভাতা পাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রে ওই নারীর ভাতা না পাওয়ার কারণ খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
জানতে চাইলে গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র মতলুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে তাঁর ভাতা পাওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’