দিনাজপুরে মালবোঝাই ট্রাকে আগুন, কপাল পুড়ল গুলজারের

দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে গেছে মালবোঝাই ট্রাক। সোমবার সকালে দিনাজপুর শহরের আনন্দসাগর নেমতাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

অন্যের গাড়িতে চালক হিসেবে চাকরি করতেন গুলজার হোসেন (৪৯)। বছর দুয়েক আগে জমানো কিছু অর্থ ও ব্যাংকঋণ নিয়ে আধা পুরোনো একটি ট্রাক কিনেছেন। নিজের গাড়ি নিজেই চালান। যা আয় করেন তা দিয়ে স্ত্রী, দুই সন্তান, মা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে দিন কাটছিল তাঁর। সেই ট্রাকটি পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

রোববার রাতে ট্রাকটিতে ভুট্টা বোঝাই করে বাড়ির পাশেই দিনাজপুর শহরের আনন্দসাগর নেমতাড়া এলাকায় গ্যারেজে রাখেন গুলজার। রাত পোহালেই সেই ভুট্টা চট্টগ্রামের মিরসরাই নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু ভোরে এলাকায় মানুষের চিৎকার শুনে বাড়ির বাইরে এসে গুলজার দেখেন তাঁর ট্রাকটি দাউদাউ করে জ্বলছে।

ট্রাকের ইঞ্জিনের অংশে আগুন দেওয়া হয়। এতে সামনের পুরো অংশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। একমাত্র সম্বল হারিয়ে আহাজারি করছিলেন ট্রাকের মালিক গুলজার হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার কারও সাথে কোনো শত্রুতা নাই। কোনো দলও করি না। অথচ নাশকতাকারীরা আমার গাড়িটিই পুড়িয়ে দিল। একটা আতঙ্ক তৈরি করার জন্য আগুনটা লাগানো হইছে। গাড়ির কাগজপত্রসহ ইঞ্জিন পুড়ে গেছে, মালগুলা নষ্ট হইছে। ৭-৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হইছে।’

গুলজার আরও বলেন, ‘ইঞ্জিনটা তো পুড়ে গেছে। গাড়িটাই আমার সম্বল ছিল। গাড়ির আয় দিয়ে ছয়জনের সংসার। ২৮ লাখ টাকার গাড়ি। এখনো কিস্তিই শোধ হয়নি গাড়ির। আমার সব শেষ করি দিছে ভাই।’

দিনাজপুরে পুড়ে যাওয়া ট্রাকের মালিক গুলজার হোসেন

দিনাজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শেখ জিন্নাহ আল মামুন বলেন, ভোররাতে গাড়িতে আগুন দেওয়ার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উপস্থিত হয়ে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছেন। এ বিষয়ে পুলিশ তদন্ত কার্যক্রম করছে। কোতোয়ালি থানায় একটি মামলার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

ঢিমেতালে অবরোধ

এদিকে বিএনপির ডাকা চতুর্থ দফা অবরোধের শেষ দিন ছিল সোমবার। ট্রাকে আগুন দেওয়ার আগে গত ২৯ অক্টোবর শহরের পুলহাট এলাকায় ককটেল উদ্ধার ও পুলিশের ফাঁকা কাঁদানে গ্যাসের ছোড়ার ঘটনা ঘটেছিল। বিএনপি হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দিলেও তা কার্যত ঘোষণা পর্যন্তই থেকে গেছে। দুই সপ্তাহ ধরে দলীয় কার্যালয় কিংবা শহরের অন্য কোনো স্থানে হরতাল–অবরোধ পালনের কোনো কর্মসূচির দেখা মেলেনি। পুলিশের মামলা ও গ্রেপ্তার অভিযান–আতঙ্কে দলের সব নেতা–কর্মী রয়েছেন আত্মগোপনে। এমনকি অনেকের মুঠোফোন পর্যন্তও বন্ধ।

আজ সকাল থেকে শহরের মির্জাপুর বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গত কয়েক দিনের অবরোধে দূরপাল্লার বাসসহ আন্তজেলা বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও সকাল থেকে কয়েকটি রুটে আন্তজেলার বাস চলাচল শুরু হয়েছে।

শহরের কলেজ মোড় এলাকায় লাইনম্যান বাবু ইসলাম বলেন, দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁও পর্যন্ত বাস চলছে। ওদিকে বিরামপুর এবং সৈয়দপুর রাবেয়া পর্যন্ত চলছে। তবে সব মালিক গাড়ি চালাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘কী করবে ভাই, পেট তো চলে না, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি বাইর করেছেন অনেকেই। আমি লাইনম্যানের কাজ করি। গাড়ি প্রতি যা পাই তা দিয়ে সংসার চলে।’

দিনাজপুর সড়ক পরিবহন বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি ভবানী শংকর আগরওয়াল বলেন, ‘একটি বাসের দাম ৩০-৩৫ লাখ টাকা। অনেক মালিক আছেন যাঁর একটি বাস। সেটিই তার জীবিকার একমাত্র উৎস। যাত্রী ও শ্রমিকদের অসুবিধার কথা চিন্তা করে ঝুঁকি নিয়ে কিছু কিছু রুটে বাস চলাচল শুরু করা হয়েছে। তা–ও ভেঙে ভেঙে গাড়ি চলছে।’

নতুন মামলা ও গ্রেপ্তার

গত ২৪ ঘণ্টায় দিনাজপুরে বিশেষ ক্ষমতা আইনে নতুন একটি মামলা করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন মামলায় ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ১০ জন এবং জামায়াতের সঙ্গে দুজন। গত ২৮ অক্টোবর থেকে জেলার ১৩টি থানায় ১৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা বাদে এজাহারভুক্ত আসামি রয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন শ। আর ২৮ অক্টোবর থেকে সোমবারের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় বিএনপি-জামায়াতের প্রায় ২০০ নেতা–কর্মী আটক হয়েছেন।

এদিকে সরাসরি মাঠে না থাকলেও হরতাল-অবরোধ সফলভাবে পালিত হচ্ছে—এমনটিই দাবি করেছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ। মুঠোফোনে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জনগণের হরতাল, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার হরতাল। জনগণই তা সফল করে তুলছে। খোঁজ নিয়ে দেখেন কোনো গাড়ি চলেনি, অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে সাধারণ মানুষ এই হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি সফল করেছে।