ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের শিকার আরও ৪ ছাত্রী

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা ক্যাম্পাস ছাড়ার পর মুখ খুলেছেন এই চার ছাত্রী। 

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) এক নবীন ছাত্রীকে নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী ওরফে অন্তরা ও তাঁর অনুসারী তাবাসসুম ইসলাম গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

চারজন ছাত্রী গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সানজিদা তাঁদের মানসিকভাবে নির্যাতন করেছেন। এমনকি তিনি কারও কারও অভিভাবককে ফোন করে কুৎসা রটিয়েছেন। ছাত্রীদের দাবি, ছাত্রলীগের পদ পাওয়ার পর সানজিদা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। হলে থাকতে হলে তাঁর মানসিক নির্যাতন সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না। 

চার ছাত্রীর তিনজন এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। একজন কিছুদিন আগে পড়াশোনা শেষ করে হল ছাড়েন। তাঁদের একজন প্রথম আলোকে বলেন, সানজিদার ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করেন না।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কয়েক দিনের মাথায় ১২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা ও তাঁর অনুসারী তাবাসসুমসহ কয়েকজনের নিষ্ঠুরতার শিকার হন এক ছাত্রী। নেত্রীদের কথা না শোনার অভিযোগ তুলে তাঁর ওপর সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালানো হয়। এ সময় অকথ্য ভাষায় গালাগাল, মারধর ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়।

ছাত্রলীগের পদ পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সানজিদা।

■ কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। 

■সাড়ে চার ঘণ্টা নির্যাতনের শিকার ছাত্রী আজ ক্যাম্পাসে যাবেন।

এ ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর গত বৃহস্পতিবার বিষয়টি তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আদালতের নির্দেশে অভিযুক্ত দুই ছাত্রী তদন্ত চলাকালে যাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে না থাকেন, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়। তবে তদন্ত কমিটি গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত গঠিত হয়নি বলে জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম। 

ছাত্রলীগের পদ পেয়ে ‘আরও বেপরোয়া’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আটটি হলের মধ্যে তিনটি মেয়েদের। এর একটি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল। হলটির ৪০৮ নম্বর কক্ষে থাকেন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসভাপতি সানজিদা, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। আর তাবাসসুম থাকেন একই হলের গণরুম প্রজাপতিতে। তিনি ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ সদস্যের একটি আংশিক কমিটি ঘোষণা করে ছাত্রলীগ। সেখানে সানজিদা সহসভাপতি পদ পান। ছাত্রলীগের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাতের অনুসারী সানজিদা। এ জন্য অল্প সময়ে তিনি পদ পেয়ে যান। পদ পাওয়ার পর থেকে হলের সবকিছুতেই তিনি দাপট দেখাতে শুরু করেন।

হলের আবাসিক এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে ব্যক্তিগত একটি বিষয় নিয়ে সানজিদা হলের অতিথিকক্ষে (গেস্টরুম) তাঁর বন্ধুদের ডেকে অপমান করেছিলেন। পাশাপাশি তাঁর বাড়িতে মায়ের কাছে ফোন করে কুৎসা রটিয়েছিলেন। তিনি বলেন, অত্যন্ত নোংরা কথা সবার কাছে বলে বেড়ানোয় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। 

ছাত্রীরা জানান, হলের যে কক্ষে সানজিদা থাকেন, সেখানকার বারান্দায় যাওয়াও নিষেধ। তাঁর সামনে কেউ গেলে মাথা নিচু করে থাকতে হয়। নইলে অপদস্থ হতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে সম্প্রতি পড়াশোনা শেষ করা এক শিক্ষার্থী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মাস তিনেক আগে একটি বিষয়ে সানজিদার সঙ্গে তাঁর তর্ক হয়েছিল। তখন সানজিদা তাঁকে বলেন, তাঁর কাছে ওই ছাত্রীর ব্যক্তিগত অডিও-ভিডিও রয়েছে। সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হবে।  

অভিযোগের বিষয়ে চেষ্টা করেও সানজিদার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গত মঙ্গলবার দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে করা সব অভিযোগ মিথ্যা। 

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, সহসভাপতি হওয়ার পর সানজিদা তাঁর ১৫ থেকে ২০ জন অনুসারী নিয়ে হলের নিয়ন্ত্রণ নেন। এক ছাত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর সোমবার দিবাগত গভীর রাতে তিনি জোর করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বাইরে বের করেন। তাঁদের দিয়ে নিজের পক্ষে কর্মসূচি পালন করান।

ছাত্রলীগ সানজিদার বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকীর কাছে সানজিদার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং সেটা তদন্ত সাপেক্ষে। 

ছাত্রীটি আজ ক্যাম্পাসে যাবেন

এদিকে নির্যাতনের শিকার ছাত্রী আজ শনিবার ক্যাম্পাসে যাবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা ও হলের প্রভোস্ট তাঁকে ক্যাম্পাসে যেতে বলেছেন। মুঠোফোনে ওই ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখনো শারীরিক ও মানসিকভাবে খুবই দুর্বল। এরপরও স্যাররা ডেকেছেন। আমি যাব।’ 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজে ছাত্রীসহ তাঁর বাবার সঙ্গে কথা বলেছি। ক্যাম্পাসে তাঁর নিরাপত্তা দেওয়া হবে জানিয়েছি।’